ভারতের ব্যর্থতাকেই কি অনুকরণ করব?
- শিশির ভট্টাচার্য্য
পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সম্প্রতি ইংরেজি ভাষায় বিসিএস পরীক্ষা নেবার সরকারি সিদ্ধান্তের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা সরকারি কাজে বিদেশ গমন কিংবা বিদেশি সরকার ও বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বা দরকষাকষির প্রয়োজনে প্রশাসনে ইংরেজি জানা সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
একজন সচিবের কোন গুণটি থাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ: ইংরেজি বলতে পারা, নাকি যুক্তিপূর্ণভাবে চিন্তা করে প্রশাসনকে সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শটি দিতে পারা? সভ্যতার ঊষাকাল থেকে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে দোভাষী ব্যবহার করা হচ্ছে। একজন চীনা বা জাপানি পররাষ্ট্র সচিব কি দোভাষীর মাধ্যমে বিদেশে নিজের যাবতীয় কর্তব্য সম্পাদন করেন না? মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার রাষ্ট্রভাষা ব্যবহার করার মধ্যে এক ধরনের আভিজাত্য ও গৌরবও আছে। বঙ্গবন্ধু জাতিসঙ্ঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন, কারণ তিনি বাংলা ভাষার গৌরবে বিশ্বাস করতেন।
পৃথিবীর ২৫টি উন্নত দেশের মধ্যে মাত্র ৮টিতে ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা। ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের আর কোনো দেশের দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি নয়। যে ৫৫টি দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস আছে, তার মধ্যে ১০টির মতো দেশের দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি। বিশ্বের ১৯৬টি দেশের মধ্যে যে ৫৫টিতে ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা— তার মধ্যে ২৬টির মতো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নিয়মিত যোগাযোগ হয়ে থাকে। উপর্যুক্ত ২৬টি দেশের মধ্যেও যে উন্নত/উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাংলাদেশের আমলাদের প্রশিক্ষণ নেবার সম্ভাবনা আছে সেগুলোর সংখ্যা ১০/১২টির বেশি হবে না।
যে-কোনো ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করার জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ ঘণ্টা সেই ভাষাটি শেখা যথেষ্ট। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় ১৫০০ ঘন্টা ইংরেজি শেখার পরেও আমাদের আমলারা কী কারণে ইংরেজি বলতে পারেন না? টোয়েফেল বা আইইএলটিএসের মতো ইংরেজিতে দক্ষতা নিরূপণ পরীক্ষায় কারা বেশি ভালো ফল করে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা, নাকি বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা? এইসব প্রশ্নের উত্তর না জেনে ইংরেজি জানা প্রার্থীর সন্ধানে ইংরেজিমাধ্যমে পরীক্ষা নেবার কোনো অর্থ নেই, বিশেষত যখন দেখি, দৈনিক পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে ইংরেজির পক্ষে যারা মন্তব্য লিখেছেন, তাদের বেশিরভাগের ইংরেজির মান প্রশংসনীয় নয়।
ইংরেজিতে যারা পরীক্ষা দেবেন, তারা নাকি বাংলা জ্ঞানহীন কর্মকর্তা হবেন না, কারণ তাদেরও ২০০ নম্বরের বাধ্যতামূলক বাংলা পরীক্ষা দিতে হবে। বর্তমানে কার্যরত আমলারা যদি ইংরেজি পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও ভালো ইংরেজি বলতে-লিখতে না পারেন, তবে বাংলা পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থীরা যে ভালো বাংলা বলতে-লিখতে পারবেন তার নিশ্চয়তা কী? বাংলা না শিখে যখন সরকারি চাকরিও পাওয়া যাবে, তখন কে আর বাংলা শিখতে চাইবে? কোনো কারণে বিসিএসের পর পর কয়েকটি ব্যাচে বাংলা কম জানা আমলারা যদি বেশি সংখ্যায় ‘চান্স পেয়ে যায়’, তবে প্রশাসন যে এক সময় বাংলা না জানা আমলায় ভরে যাবে না তার নিশ্চয়তা কী?
সরকারি কর্মকমিশনের ২১নং বিধিতে নাকি বাংলা অথবা ইংরেজি যে-কোনো একটি ভাষায় উত্তর দেবার কথা লেখা আছে। ১৯৭২ সালে সংবিধান কিংবা ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিধিটি কি গ্রহণযোগ্য? ইংরেজি ভাষায় যারা পড়াশোনা করেছেন, অর্থাৎ প্রধানত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আমলাতন্ত্রে আকৃষ্ট করার কথা বলা হচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। জনগণের অর্থে পরিচালিত মঞ্জুরি কমিশন কীভাবে সংবিধান এবং বাংলা প্রচলন আইনকে অগ্রাহ্য করে ইংরেজিকে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে?
বাংলাদেশের কিছু নামীদামী সরকারি বিদ্যালয়ের ইংলিশ ভার্সন, এ-ও লেবেল, চিকিত্সাবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা আইবিএতে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্যে যাঁরা সংগ্রাম করেছিলেন, তাদের বংশধরেরা, এমনকি বাংলার বিখ্যাত অধ্যাপকদের নাতিনাতনিরাও নাকি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে। সুতরাং ইংরেজিতে বিসিএস পরীক্ষা নিতেই হবে। আত্মহত্যা মহাপাপ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ জেনেও যদি কোনো দেশে কিছু অবিমৃশ্যকারী বিখ্যাত লোক গলায় দড়ি দেয়, তবে সে দেশের সরকারের কি উচিত হবে সর্বসাধারণের জন্যে ম্যানিলা দড়ি সরবরাহ করা?
শিক্ষাসহ জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিরোধিতা যারা করেন, তারা প্রায়ই বলে থাকেন, যে বাস্তবতায় সালাম-রফিক-বরকতেরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্যে সংগ্রাম করেছিলেন, সেই বাস্তবতা নাকি এখন বদলে গেছে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের একটি শ্রেণি চেয়েছিল, উর্দুর স্বার্থে বাংলাভাষার অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নিতে। আজ অন্য একটি শ্রেণি অথবা হয়তো সেই একই শ্রেণির উত্তরপুরুষেরা চাইছে, ইংরেজির স্বার্থে বাংলা ভাষাকে তার অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে। বলা বাহুল্য, বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক অধিকার এবং বাংলাভাষীদের অর্থনৈতিক অধিকার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
ভারতে যথেষ্ট কম পরীক্ষার্থী বাংলা, হিন্দি, তামিল ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে থাকে। এর মানে হচ্ছে, স্বাধীনতার ৭০ বৎসর পরেও অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো ভারত রাষ্ট্র তার ভাষাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় তরুণ ইংরেজি শব্দের গোঁজামিল না দিয়ে ভারতীয় ভাষাগুলো বলতেই পারে না। ভারতের ব্যর্থতাকেই কি আমরা অনুকরণ করব? পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উর্দু ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে, কারণ দেরিতে হলেও পাকিস্তানের বিচার বিভাগ রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা বুঝতে পেরেছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ বাংলাভাষার অর্থনৈতিক অধিকার নয়, বরং ভাষাদূষণের মতো কাল্পনিক সমস্যার প্রতি বেশি মনোযোগী, যদিও স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরেও আদালতের কাজকর্ম চলে ইংরেজিতে।
আমাদের জানতে হবে, বাংলাদেশের সরকারি কাজের কোনো কোনো ক্ষেত্রে এবং আমলাতন্ত্রের ক্ষমতানুক্রমের কোনো কোনো পর্যায়ে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অপরিহার্য। হিসাব করে দেখতে হবে, রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর জন্য ন্যূনতম কতজন লোক ভালো ইংরেজি না জানলেই নয়। বাংলাদেশের আমলারা ইংরেজি জানেন না, এমন নয়, অব্যবহারে ইংরেজিতে তারা দুর্বল। যদি ঘোষণা করা হয়, আইইএলটিএস পরীক্ষায় আট কিংবা টোয়েফেল পরীক্ষায় একশ স্কোর করলে কমপক্ষে একটি প্রমোশন এবং একাধিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে, তবে কয়েক বছরের মধ্যে বহু আমলার ইংরেজির দুর্বলতা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা কোনো সমস্যার সহজ সমাধানে আগ্রহী নন। তাঁরা সব সময় ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিতে চান, যার ফলে গাড়ি তো কখনোই এগোয় না, বরং ঘোড়ার নাক কেটে জনগণের যাত্রাভঙ্গ হয়।
লেখক : অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়