বেকারত্বের নেপথ্য কারণ
- ড. আর এম দেবনাথ
দুই-তিনদিন আগে প্রেসক্লাবের লাইব্রেরিতে বিদেশি একটি ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। এতে পেয়ে গেলাম ‘টেকনোলজির’ ওপর একটা ‘স্টোরি’। ‘টেকনোলজি’ নয় সেই অর্থে, ‘টেকনোলজির’ সাথে সম্পর্কিত করে কর্মসংস্থানের ওপর ছিল স্টোরিটি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হারের পাশাপাশি কর্মসংস্থান কতটুকু হচ্ছে এই ছিল আলোচ্য বিষয়। স্টোরিতে দেখানো হচ্ছে কীভাবে দেশে দেশে ‘টেকনোলজি’র উন্নতি হচ্ছে, ‘টেকনোলজি’ উদ্ভাবিত হচ্ছে, প্রয়োগ হচ্ছে এবং ফলে কীভাবে ‘উন্নতি’ হয়ে যাচ্ছে চাকরিবিহীন অগ্রগতি বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু মানুষ হচ্ছে চাকরিবিহীন, কর্মহীন, বেকার। সৃষ্টি হচ্ছে না প্রয়োজনীয় সংখ্যক চাকরি। এই ‘স্টোরিটি’ পড়তে পড়তে বারবার থামছিলাম, হজম করার চেষ্টা করছিলাম, বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তাহলে ঘটনাটি কী? ‘টেকনোলজি’ বা অন্য অর্থে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কী তাহলে মানুষের ‘শত্রুতে’ পরিণত হবে?
দৃশ্যত ‘টেকনোলজি’ ছাড়া আমাদের চলবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি ‘টেকনোলজিতে’। এই ‘টেকনোলজি’ প্রতিযোগিতার শক্তি দেয়, পণ্যের উৎদন ব্যয় কমায়। দেশের উন্নতি ঘটায়। অর্থনীতি সাবালক হয়। যে দেশ ‘টেকনোলজিতে’ যত উন্নত, সেই দেশ তত বেশি ধনী, উন্নত, অগ্রসর। সেই দেশের লোক তত বেশি ‘সুখী’। কিন্তু পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে ‘টেকনোলজি’ মানুষকে কর্মচ্যুত করছে, বেকার করছে। বিপরীতে নতুন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এখন কী তাহলে এসব কথাই চিন্তা করতে হবে, এই সমস্যা নিয়ে তাহলে এখন থেকেই ভাবতে হবে? এসব চিন্তা-দুশ্চিন্তা নিয়ে ঐদিন প্রেসক্লাবের লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসি। ভাবি আর ভাবি তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াচ্ছে?
এই যেমন চাক্কাওয়ালা ব্যাগ। কী ভীষণ সুবিধাজনক একটা ছোট ‘টেকনোলজি’। সে কী করেছে? করেছে শত-শত কুলিকে বেকার। তাই নয় কী? রেলস্টেশন, স্টিমার স্টেশন ইত্যাদিতে লাল কাপড়ের কুলিরা কী দাপুটে একটা শ্রমজীবী ছিল? আজ? আজ তার সামনে দিয়েই হুটহুট করে চাক্কাওয়ালা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যাত্রীরা? কুলিদের কী হলো? তাদের বিকল্প ব্যবস্থা কী হয়েছে? কাঁচাবাজারে ‘উমাচরণ কর্মকারের’ ওজনের নিক্তি ছিল। অতি পরিচিত ও বিশ্বস্ত নাম ওজনের ক্ষেত্রে। আজ কী তা আছে? নেই। এর বদলে বসেছে চাইনিজ ওজনের মেশিন— দোকানে-দোকানে। এক মেশিনে দুই কাজ। ওজন ও দাম। ওজন কত, পণ্যের দাম কত একবারে পাওয়া যায়। ছোট টেকনোলজি, কত সুবিধা- তাই না? কিন্তু শত-শত কর্মকার (কারিগর) এখন কী করছে? তাদের কী বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান হয়েছে? আমাদের কৃষির কথাই ধরা যাক। হালের গরু এখন গ্রামে বিরল। ফসল লাগানো, ফসল তোলা, নিড়ানি, সার ছিটানো, ধান থেকে চাল করা— সবই এখন হয় মেশিনে। সরকার তাতে উত্সাহ জোগাচ্ছে। সরকার ভর্তুকি দেয়। কারণ গ্রামে ও শহরে বলা হচ্ছে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে শ্রমিকের বড় অভাব। তাদের মজুরি আকাশচুম্বি। অতএব ‘নাজ্যপন্থা’। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ করতেই হবে। এর প্রভাব পড়েছে রিকশার বাজারে। উত্তরাঞ্চলের রিকশাওয়ালায় ঢাকা শহর ভর্তি। কয়েকদিন আগেও ঢাকায় রিকশা ছিলো বেশি, চালক কম। কারণ? তারা ‘দেশে’ গেছে কৃষির কাজ করতে। এই মুহূর্তের খবর- তারা আবার ফিরছে। ‘দেশে’ কৃষির কাজ আর নেই। আবার তারা ‘দেশে’ যাবে বৈশাখের দিকে যখন ‘বোরো’ ফসল উঠবে। তাহলে কী হলো? এই যে বললাম গ্রামে ‘শ্রমিকের অভাব’। শ্রমিকের যদি অভাব হবে তাহলে হাজারে হাজারে তারা ঢাকায় আসছে কেন? কেন এসে রিকশা হাতে নিচ্ছে? প্রচুর রিকশা ঢাকায়। বিকেলে রাস্তায় দেখা যাবে রিকশাওয়ালারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রী ছাড়া ঘুরছে। যাত্রী নেই। তার অর্থ কী প্রচুর সংখ্যক যাত্রী নেই? এমনই তো মনে হয়।
মজার বিষয়, সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মীর সংখ্যা এই ২৩ বছরে হ্রাস পেয়েছে অথচ তাদের কাজ বেড়েছে অনেকগুণ। ব্যবসা বেড়েছে অনেকগুণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মীসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কর্মীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংকেও। এসবের কারণ কী?
ধরা যাক, পোশাক খাতের কথা। এই কারখানাগুলো বিগত দেড়-দুই শতকে লাখ-লাখ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান করেছে। বড়ই সুখের ঘটনা। এখন কী হচ্ছে এই খাতে? কয়েকদিন আগে ঢাকায় একটা সেমিনার হয়েছে। তাতে শ্রম ও শ্রমিকের ওপর যারা গবেষণা করেন তাদের একজন একটা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। কাগজে দেখলাম ঐ নিবন্ধে বলা হচ্ছে, পোশাক খাতে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে পড়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই খাতে নতুন কর্মসংস্থান হয়নি। কারণ এখানেও প্রধানত ‘টেকনোলজি’। ‘বায়ারদের’ তাগিদে পোশাক কারখানার বড় বড় ধনী মালিকরা এই খাত আধুনিকায়ন করছে। এমন সব মেশিন বসানো হচ্ছে যাতে শ্রমিকের প্রয়োজন কম হয়। এমন সব কারখানাও এখন আছে যেখানে নাকি ‘রোবট’ও বসানো হচ্ছে। কারণ, বিদেশি প্রতিযোগিতা। শ্রমিকদের মজুরি, বর্ধিত মজুরি দিয়ে বিদেশের বাজারে টেকা কঠিন কাজ। সাফ কথা।
তাহলে উপায়? উপায় শ্রমিক কম, উৎপাদন বেশি, উৎপাদন ব্যয় কম। যেন শ্রমিকের সাথে, শ্রমের সাথে উৎপাদনের অথবা অর্থনীতির বিরাট বিরোধ। শ্রমিক পুষে ব্যবসা হয় না, প্রতিযোগিতা হয় না। একথা তো অসত্যি দেখা যাচ্ছে না। অতএব, মালিকরা ঝুঁকছেন শ্রমিকবিহীন মেশিনের দিকে। রোবটের দিকে। প্রশ্ন- তাহলে শ্রমিক, নারী শ্রমিক শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে? ওদের বিকল্প কর্মসংস্থান কোথায় হবে? সবাই কি শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তা হবে? সবাই হবে ব্যবসায়ী ? তাহলে পণ্য কিনবে কে? অনেক প্রশ্ন।
আইটি সেক্টর একটা বিকাশমান খাত। এর রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে দিনদিন। সরকার আইটি খাতকে ভর্তুকি দিচ্ছে, তাতে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কাজ করে বড় বড় সব কোম্পানি। বহুজাতিক কোম্পানিও আছে। তাদের বিক্রয় দিন দিন বাড়ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের বাত্সরিক বিক্রয়ের পরিমাণ, তারা দেশি ব্যাংক থেকে ঋণও পায়। অথচ তাদের বিদেশ থেকেই ফান্ড আনার কথা। এমন একটা বিকাশমান খাতে চাকরিসংস্থান-কর্মসংস্থানের অবস্থা কী? সেখানে কি প্রতিবছর লোকের নতুন নতুন চাকরি হয়? না, তা নয়। প্রতিবছর নতুন নতুন টেকনোলজি বসে, ইনোভেশন হয়। নতুন নতুন উদ্ভাবনী পণ্য। নতুন নতুন প্যাকেজ। ফল? ফল হচ্ছে প্রতিবছর লোকের চাকরিচ্যুতি। চাকরিচ্যুতরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে।
টেকনোলজি ভালো বেতন দেয় জীবনের প্রথমে, মধ্য বয়সে টেকনোলজি বলে বাড়ি যাও— তোমাকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। তুমি অকেজো। ফলে আইটি খাতে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। উল্টো বরং লোকের চাকরি যাচ্ছে। অথচ তাদের মুনাফা বাড়ছেই। আসা যাক ব্যাংকিং খাতে। কী ঘটছে এই খাতে? এই খাতে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ছে। ব্যাংকিং পণ্য বাড়ছে। ব্যাংকের ব্যবসা হৈ হৈ করে বাড়ছে। ব্যাংক প্রতিবছর ভালো মুনাফাও করছে। আমানত, ঋণ, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসা, আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা বাড়ছে তো বাড়ছেই। তাদের আয় বিগত তেইশ বছরে বেড়েছে প্রায় ৩৩ গুণ। এই হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক নেই। হিসেবে আছে শুধু তফসিলী ব্যাংক। দেখা যাচ্ছে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৩৩ গুণ আয় বৃদ্ধির বিপরীতে তাদের খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র পৌনে দুই শতাংশ। ১৯৯৩ সালে বাণিজ্যিক ব্যাংকিং খাতে কাজ করতো ৮৩ হাজার ৫৯৪ জন। সেই ক্ষেত্রে ২০১৫ সালে কর্মরত লোকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৪ হাজার ৯০ এ। মজার বিষয়, সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মীর সংখ্যা এই ২৩ বছরে হ্রাস পেয়েছে অথচ তাদের কাজ বেড়েছে অনেকগুণ। ব্যবসা বেড়েছে অনেকগুণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মীসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কর্মীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংকেও। এসবের কারণ কী?
কারণ, টেকনোলজি। ব্যাংকগুলোতে টেকনোলজি প্রতিনিয়ত আপগ্রেড হচ্ছে। জনগণের পক্ষ থেকে, মিডিয়ার পক্ষ থেকে এই ক্ষেত্রে চাপ আছে। তাহলে কী বলব। টেকনোলজি ব্যাংকিং খাতকেও কর্মীশূন্য করছে? এই খাতে হরদম লোকের চাকরি যাচ্ছে। যেসব ব্যাংক থেকে চাকরি যাচ্ছে কর্মীদের, সেখানে মুনাফা কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে। এখানেও কী টেকনোলজির ফল ভুগছে ব্যাংক কর্মীরা? এসব ক্ষেত্রে ভাবার দরকার।
আসা যাক দেশের ক্ষেত্রে। একটি সেমিনারে পঠিত একটি নিবন্ধের কথা মিডিয়া রিপোর্টে পড়লাম। খবরটির শিরোনাম: প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি প্রহেলিকা। প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এক দশমিক আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি দিয়ে এক শতাংশ কর্মসংস্থান বেড়েছে। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সেই এক শতাংশ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে লেগেছে দুই দশমিক ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু লোকের চাকরির সুযোগ বাড়ছে না। এটা কি হাইটেকনোলজি গ্রহণের ফল? এটা কি ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ ইন্ডাস্ট্রি করার ফল? এসবের উত্তর দরকার। শত হোক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি মানুষের জন্যই। এর জন্য টেকনোলজিও লাগবে। কিন্তু টেকনোলজি যদি মানুষকে চাকরিবিহীন করে, কর্মচ্যুত করে, বেকার করে, অন্নহীন করে, তাহলে পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াবে? তাহলে কি মানুষের জায়গা রোবট নিয়ে নেবে?
সমাধান তাহলে কি ‘নেগেটিভ জন্মহার?’ এসব কথা আগে ভাবতে হতো না। এখন ভাবতে হচ্ছে। কারণ আমরা উন্নয়নের পথে, আমাদের আরো উন্নয়ন চাই। দেশে লোকসংখ্যা ১৬-১৭ কোটি। বাংলাদেশ ইউরোপের দেশের মতো কোনো দেশ নয়। এত লোককে তো টেকনোলজির শিকার করা যাবে না। কত লোকের দেশেও এখন টেকনোলজির শিকার মানুষকে করা যাচ্ছে না। বিশ্ব আবার ওলট-পালটের মুখে। উদার বাণিজ্য, অবাধ বাণিজ্য, প্রতিযোগিতা, দক্ষতা, কানেকটিভিটি, কর্মসংস্থান, আউটসোর্সিং, যান্ত্রিকীকরণ, এসবের অনেকগুলোই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এসব ব্যাপারে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সজাগ। তিনি কর্মসংস্থান হয় এমন প্রকল্পের কথা বলছেন। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের কথা বলছেন। দেশীয় বাজার সৃষ্টির কথা বলছেন। মধ্যবিত্তকে রক্ষার কথা বলছেন। সরকারের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে এসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা দরকার।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়