বেকারত্বের কঠিন বাস্তবতা ও তরুণ প্রজন্ম
- আল মামুন ও নাবিহাতুল আফরোজ
টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা হলো বেকারত্ব। সিপিডি-এর ২০১৬ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সামগ্রিক বেকারত্ব স্থিতিশীল থাকলেও বছরের পর বছর ধরে তরুণদের মাঝে এই সমস্যা চরম থেকে চরমতর হচ্ছে। দেশের জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেলেও কর্মসংস্থানের বিষয়টি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। তৈরি হচ্ছে না দক্ষ কর্মীও। আর নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হওয়ার বিষয়টি তো আকাশ-কুসুম ভাবনার নামান্তর। বিবিএসের ২০১৬ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৩৩ শতাংশই তরুণ (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী), যাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি দুই লাখের মতো। তাছাড়া পরিস্থিতি অনুসারে আগামী দশ বছরে দেশে কর্মযোগ্য মানুষের সংখ্যা বার্ষিকভাবে বৃদ্ধি পাবে দুই কোটিরও অধিক। কর্মক্ষেত্র তৈরির এই দৈন্যদশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেকারত্বের ধারা যদি এভাবেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে; তবে ভবিষ্যতে সমস্যাটি যে দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে—তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সামগ্রিক বেকারত্বের তুলনায় বৈশ্বিক পরিসরেও তরুণ বেকারত্বের সমস্যাটি দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, বর্তমানে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তরুণ বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই ধরনের তরুণরা শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গেও জড়িত নয়। তাছাড়া আইএলও-এর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, পরবর্তী দশকে চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে প্রায় আরো একশ কোটি তরুণ, যাদের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ চাকরি পেতে সক্ষম হবে।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট তরুণ বেকারত্বের হার ৯.১ শতাংশ। সামগ্রিক পুরুষ বেকারত্বের তুলনায় যা ৮.৯ শতাংশের মতো। তাছাড়া ২০১৪ সালের বিশ্ব যুব বেকারত্বের র্যাংকিংয়েও বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ তম এবং যুব পুরুষ বেকারত্বের র্যাংকিংয়ে ১৫৬ তম। অতীতের প্রেক্ষাপটে নিশ্চয়ই এই পরিসংখ্যানকে আমরা ভালো বলতে পারি না। কেননা, ১৯৯১ সালেও দেশে যুব বেকারত্বের হার ছিল ৮.২ শতাংশের মতো।
আইএলও-এর ২০১৫ সালের রিপোর্টেও বাংলাদেশের যুব বেকারত্বের এক হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে যুব বেকারত্বের হার ছিল শতকরা ১০.৩ ভাগ। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, দেশটির শতকরা ৯৫ ভাগেরও অধিক তরুণ শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক কর্মের সঙ্গে জড়িত, যাদের মধ্যে ৩১.৭ শতাংশ আবার নিজের টুকিটাকি কাজ বা মূল্যহীন পারিবারিক শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উপরন্তু বেকার তরুণদের শতকরা ৪১ ভাগই শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত নয়। তবে যুব নারীদের কর্মসংস্থানের সমস্যাটি মনে হয় এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে হতাশাজনক দিক। কেননা যুব বেকারদের সবচেয়ে বড় অংশ হলো তরুণ নারী। বেকারত্ব ও মূল্যহীন শ্রমের পাশাপাশি তাদের দুই-তৃতীয়াংশেরই (৬৪.৪ শতাংশ) শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে কোনো প্রকারের সংযোগ নেই। তবে এই সমস্যার মূলে কিছু সামাজিক প্রতিবন্ধকতাই মনে হয় বহুলাংশে দায়ী। উদাহরণ হিসেবে বাল্য বিবাহ, নিরাপত্তাহীনতা এবং কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের অসুবিধাগুলোই সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।
সিপিডির সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে দেশে যুব বেকারত্বের হার ছিল ৮.১ শতাংশ। কিন্তু ২০১৫ সালে তা ৯.৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। শুধু নির্দিষ্ট এই দুই বছরেই নয়, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই কয়েক বছরেই বলা যায় যুব বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সব সময়ের মতো এই সময়েও পুরুষের তুলনায় মহিলা বেকারের সংখ্যাই ছিল অধিক।
তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ও সামগ্রিক বিবেচনা থেকে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, সামপ্রতিক বছরগুলোতে দেশে যুব বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এই সময়ে দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি থেমে থাকেনি। তবে তা বেকারত্ব বৃদ্ধির তুলনায় স্থিতিশীলই ছিল। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাত্সরিকভাবে গড়ে এই বৃদ্ধির পরিমাণ শতকরা প্রায় ১.৫ শতাংশের মতো। তথাপি জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের দেশে এখনো ইতিবাচক বিষয় নয়। কেননা, বরাবরই তা আমাদের কর্মক্ষেত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করে। তবে কর্মপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এদেশের তরুণ সমাজেরও কিছু ঘাটতি লক্ষণীয়। তা হলো—অধিকহারে গতানুগতিক শিক্ষাগ্রহণের বাস্তবতা, অদক্ষতা এবং গুণগতমানের কর্মমূখী শিক্ষা গ্রহণের পশ্চাত্পদতা। কিন্তু এই বাস্তবতা যদি আরো দীর্ঘ হয়, তবে এতে তরুণদের মাঝে হতাশা, অপরাধ প্রবণতা ও মাদকাসক্তির প্রভাব যে উল্লেখ সংখ্যক হারে বেড়ে যাবে—তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাটির যথাযথ সমাধান হওয়া উচিত। নতুবা এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে উত্পাদনশীলতা ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর।
এইজন্য সবচেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার ব্যাপারে। সঙ্গত কারণে ব্যবস্থা করতে হবে উন্নত প্রশিক্ষণের। এই ব্যাপারে প্রাইভেট সেক্টরকেও উত্সাহিত করতে হবে।
বর্তমান সরকার অর্থনীতিতে তরুণ জনগোষ্ঠীর ভূমিকা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। তাদের উন্নয়নে ২০০৩ সালে সরকার জাতীয় যুবনীতি গ্রহণ করে। সম্প্রতি (২০১৭ সালে) সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে তরুণদের কল্যাণে নতুন একটি জাতীয় কর্ম পরিকল্পনার খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। যুব উন্নয়নের জন্য এখানে এমন কিছু নির্দেশনা আছে—যা ইতোপূর্বের আর কোনো নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বিশেষ করে এই নীতিমালায় বেকার যুবক, তরুণ উদ্যোক্তা, প্রবাসী যুবক, গ্রামীণ যুবক, স্কুল থেকে ঝরে পড়া যুবক, অশিক্ষিত যুবক, অক্ষম ব্যক্তি, মাদকাসক্ত যুবক, ট্রান্সজেন্ডার যুবক, গৃহহীন যুবক এবং দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত যুবকদের উন্নয়নে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
লেখকদ্বয় : গবেষক