বিসিএস পরীক্ষা : নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির নানা দিক
- আলী ইমাম মজুমদার
ঢাকার পত্রপত্রিকায় খবরে জানা গেল, এখন থেকে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রতিটি উত্তরপত্র দেখবেন দুজন পরীক্ষক। তাঁদের প্রদত্ত নম্বরের গড়ই সে পত্রে পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর বলে বিবেচিত হবে। এত দিন পর্যন্ত একজন পরীক্ষকই উত্তরপত্র দেখতেন। আর এ ধারাবাহিকতা ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে পাকিস্তান সময়কাল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশতক চলছে। তবে এভাবে চলছিল বলেই তা চলতে থাকবে, এমন কোনো কথা নেই। মূল্যায়নের জন্য প্রচলিত প্রক্রিয়ার চেয়ে উন্নত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া গেলে তাকে স্বাগত জানানোই উচিত।
ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজ কোনো কিছুই স্থির হয়ে থাকে না। ঠিক তেমনি থাকে না সরকারি নিয়মকানুন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চতর সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এ দেশে বারবার স্থায়ী বা অস্থায়ী পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার পরপর বেশ কিছু উচ্চতর পদে নিয়োগে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কেবল মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। ‘অমুক্তিযোদ্ধাদের’ জন্য নির্ধারিত এর পরপরই পরীক্ষাটিতে লিখিত ও মৌখিক পর্ব এক দফা শেষ করে চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে চূড়ান্ত বাছাই করা হয়েছে। সময় নিয়েছিল চার বছর।
আবার ১৯৮২ সালে উপজেলা পদ্ধতি চালু হলে কর্মকর্তার নতুন বর্ধিত চাহিদা মেটাতে ঊর্ধ্বতন বয়স বিবেচনায় না নিয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের একটি পরীক্ষার মাধ্যমেও নিয়োগ দেওয়া হয় শুধু সিভিল প্রশাসনে। দু-একবার বিশেষায়িত পদেও নিয়োগ দেওয়া হয় সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়ায়। তবে বরাবর সেসব পরীক্ষার উত্তরপত্র (প্রথম পরীক্ষার কোনো উত্তরপত্রই ছিল না) মূল্যায়ন পদ্ধতি অভিন্ন ছিল। এভাবে দুজন পরীক্ষক মূল্যায়ন করলে আপাত ধরে নেওয়া যায়, চলমান অবস্থার চেয়ে মূল্যায়ন পদ্ধতি কিছুটা স্বচ্ছ হবে। আরেকজন পরীক্ষক এটা মূল্যায়ন করবেন বা করেছেন বিবেচনায় পরীক্ষকদেরও অধিকতর সতর্ক হওয়ার কথা। ফলে বিসিএস পরীক্ষায় লিখিত পর্বে অধিকতর সঠিক মূল্যায়ন হবে বলে ধারণা করা যায়।
বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান স্বয়ং। ৩৮তম বিসিএস থেকে মূল্যায়নের নতুন নিয়ম চালু করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রার্থীকে বঞ্চনা থেকে মুক্ত করতে এবং অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ঢাকা, রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদ্ধতি বিদ্যমান আছে। সুবিচার নিশ্চিতে এটা প্রয়োজন। তাঁর পরিবেশিত তথ্য সঠিক। তবে এটা অনুল্লেখিত রয়েছে যে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন পরীক্ষকের প্রদত্ত নম্বরের পার্থক্য শতকরা বিশের বেশি হলে তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। পিএসসিও এমনটা করবে, তা বলা হয়নি। অবশ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একক পরীক্ষক পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে। এর ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সনদধারীদের মাঝে মানের ব্যাপক পার্থক্য নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। তবে উচ্চতর চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় সবাই আছেন। এ ক্ষেত্রে বিসিএস পরীক্ষার জন্য দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা বাড়বে, এটা ঠিক। তবে এর সার্বিক প্রভাব সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা প্রয়োজন।
বিসিএস পরীক্ষা দেশের সব ক্যাডারে নিয়োগের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। ইদানীং যাঁরা ক্যাডার চাকরি পান না, তাঁদেরও অনেকের নন-ক্যাডার পদে উত্তীর্ণদের তালিকা থেকে পিএসসির সুপারিশ নিয়ে নিয়োগের ব্যবস্থা হয়েছে। এ পরীক্ষার তিনটি পর্ব। প্রিলিমিনারি শুধু বাছাইয়ের জন্য ২০০ নম্বরের পরীক্ষা এতে উত্তীর্ণদের থেকে চাকরির সংখ্যা ও পিএসসির সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে লিখিত পরীক্ষায় ডাকা হয়। সে পরীক্ষা পরিচালনা ও এর উত্তরপত্র মূল্যায়ন একটি সময়সাধ্য প্রক্রিয়া। আর দ্বিতীয় পরীক্ষক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সে সময়সীমা আরও বেড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। এটা পিএসসির চেয়ারম্যান নিজেই স্বীকার করলেন। তাঁর মতে, কিছুটা বাড়তি সময় গেলেও সিভিল সার্ভিসের গুণগত মান বৃদ্ধিতে এটা সহায়ক হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পিএসসি কি এতসংখ্যক যোগ্য পরীক্ষককে তালিকায় আনতে পারবে? আর তা-ও সব বিষয়ের! উল্লেখ্য, বিসিএস পরীক্ষায় পিএসসি পর্বই এখনো দেড় বছরের নিচে নামানো যায়নি। অথচ নিয়োগ পর্ব পর্যন্ত এক বছরেই শেষ হওয়ার কথা। এ বিষয়ে শুধু আমাদের প্রতিবেশী ভারতকে অনুকরণ করলেই হয়। পাকিস্তানও পিছিয়ে নেই। বছরের পরীক্ষা বছরে শেষ আর নিয়োগও হয়ে যায়। সাধারণ ও বিশেষায়িত ক্যাডারের জন্য পৃথক পরীক্ষার প্রস্তাবটি কেউ ছুঁয়েও দেখছেন না। না-ই দেখলেন। এখন এ অবস্থাতেই দুটি ভাগ করা যায়। আর সাধারণ ক্যাডারের শূন্যপদের অনধিক ১০ জনকে প্রিলিমিনারি থেকে লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকলেই যথেষ্ট। বিশেষায়িত ক্যাডারে সাধারণ শিক্ষায় বহু উপ-ক্যাডার। সেখানে এরূপ ভাগ করা একরূপ অসম্ভব।
তাই মোটা দাগে শূন্যপদের একটি অনুপাত ধরে প্রতিটি ক্যাডার, উপ-ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকা যায়। ব্যাপারটি অত্যন্ত জটিল, সন্দেহ নেই। তবে যতক্ষণ সবকিছু জগাখিচুড়ি করে রাখা হবে, ততক্ষণ তা-ই হবে। দ্বিতীয় পরীক্ষক ব্যবস্থার জন্য যে অতিরিক্ত সময় যাবে, তা কমানো যায় মৌখিক পরীক্ষায় প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে মেধা অনুসারে শুধু দুজনকে ডেকে। এরপর ফলাফল চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে যাবে নিয়োগের সুপারিশ। হবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বভাবচরিত্র-সংক্রান্ত তদন্ত। এ তদন্ত সম্পর্কে আমাদের গত দুই দশকের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা আবশ্যক। শুধু প্রার্থীর (তাঁর আত্মীয়স্বজনের নয়) কোনো ফৌজদারি বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের জন্য কাউকে অনুপযুক্ত বিবেচনা করা যাবে। তা-ও করতে হবে সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে। নচেৎ ভারতের মতো পুলিশি তদন্ত সাপেক্ষে চাকরি দিয়ে দিন। ভারতে এভাবে আইএএস, আইএফএসে নিয়োগ দিচ্ছে। আমরা পারব না কেন?
পিএসসির দ্বিতীয় পরীক্ষক দিয়ে মূল্যায়নের ধারণা আগে না থাকলেও বিবেচনা করা যায়। তবে বছরের পরীক্ষার ফলাফল বছরেই চূড়ান্ত করা নিশ্চিত করতে হবে। এটার সঙ্গে কোনো সমঝোতা করে নতুন ব্যবস্থা চালু একটি বিতর্কের সূচনা করতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক নেই। বিতর্ক ও ক্ষোভ রয়েছে অন্যায্য কোটা ব্যবস্থা ও অযাচিত বিলম্ব নিয়ে। এ অস্বাভাবিক বিলম্বের জন্য কত তরুণ-তরুণীর মূল্যবান সময়ের অপচয় হচ্ছে, এর হিসাব আমরা রাখি না। আর শেষাবধি যখন পিএসসি অনেককে খালি হাতে ফেরত দেয়, তখন থাকে না অন্য কোনো সরকারি চাকরির বয়স। এসব বিষয় সর্বোচ্চ বিবেচনায় থাকতে হবে। আর যে জট সৃষ্টি হয়েছে, তা রাতারাতি দূর হবে, এমন আশা আমরা করি না। তবে ধীরে ধীরে কাটতে থাকুক। এমনি অবস্থায় নতুন ব্যবস্থা সে বিলম্বের শঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এ পথে যেতে হলে কোমর বেঁধে নামতে হবে। দেখাতে হবে দ্বিতীয় পরীক্ষক নিলেও সময়মতো কাজ করা যায়। সে বিষয়ে প্রত্যয়ী হতে না পারলে নতুন ধারণাটি আপাতত স্থগিত রাখা সংগত হবে।
বিসিএস নিয়ে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম করিনি। আর তা করা দোষেরও নয়। চলমান একটি ব্যবস্থাকে অধিকতর কার্যকর করতে তা সব সময় করা যায়। ধরে নেওয়া যায়, এ ধরনের একটি সদিচ্ছা নিয়ে পিএসসি বিসিএসের লিখিত পর্বে দ্বিতীয় পরীক্ষক প্রথা প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তা করার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তাদের আছে কি না, এটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে অযৌক্তিক বলা যাবে না। বছরের পরীক্ষা বছরেই হবে। যেমন প্রকৃতির নিয়মে প্রতিবছর প্রত্যেকের বয়স বাড়ে এক বছর। আর এ বয়সের মোক্ষম সময়টি তারুণ্য। আমাদের দেশটি জনমিতির লাভজনক দিকে আছে। পৃথিবীর অনেক দেশের অবস্থান তার বিপরীতে। তাদের তারুণ্যের হার কমে যাচ্ছে। বাড়ছে বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা। আর আমরা এ লাভজনক দিকটিকে কাজে লাগাতে পারছি না। সরকারি চাকরির শূন্যপদে নিয়োগ দিতে পারছি না সময়মতো। অথচ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে। তাই পিএসসির এ শুভ উদ্যোগকে তখনই স্বাগত জানাব, যখন প্রচলিত নিয়মেই তারা বছরের পরীক্ষা বছরে সম্পন্ন করার সামর্থ্য অর্জন করবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।