আচরণের অর্থনীতি : প্রাইস, ভ্যালু ও ফুটানি
- সৈয়দ মিজানুর রহমান
আজকের আলাপের বিষয় হলো, প্রাইস, ভ্যালু ও ফুটানি। বাংলায় ফুটানি শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত। সারা পৃথিবীতে প্রাইস ও ভ্যালুর সংঘাতের ভেতর দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মানুষ। আমরা কোনো কিছু ক্রয়ে যে দাম দেই সেটা হলো প্রাইস। অন্যদিকে ওই পণ্য কিনে যে প্রাপ্তি ঘটে সেটা হলো ভ্যালু। কোনো একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে ১০ টাকা দিয়ে এককাপ চা খেয়ে ভালো লাগলে মনে হয়, বাহ খরচ যেমনই হোক, দুর্দান্ত প্রাপ্তি হয়েছে। ওই রেষ্টুরেন্টে বারবার যাবো। অন্যদিকে কোনো রেষ্টুরেন্ট থেকে চা খেয়ে যদি মনে হয়, টাকার সঙ্গে সময়ও বৃথা গেল, তবে দ্বিতীয়বার ওই রেষ্টুরেন্টমুখী হতে চাই না আমরা।
পৃথিবীব্যাপী যারা ব্যাবসায় করেন, তাদের টিকে থাকার মূলমন্ত্র হলো, ভোক্তার কাছে পণ্যের ভ্যালু তৈরি করা। মূলত এই ভ্যালুর জোরেই ভোক্তা ওই পণ্যের পেছনে দৌড়ায়। অন্যদিকে আমাদের মধ্যে ফুটানি নামক একধরনের প্রবণতা রয়েছে। এটা ঠিক ভ্যানিটি নয়, এটা ঠিক প্রাউডও নয়, ভ্যানিটি ও প্রাউড—এগুলো মানুষের থাকতে হয়। ফুটানি এমন একটি বিষয় যা মূল্যহীন এবং জীবনকে অযথা জটিল আবর্তে বেঁধে ফেলে। অর্থাৎ আমার যা নেই তা কৃত্রিমভাবে প্রকাশ করতে হবে, প্রদর্শনেই আমরা আনন্দ খুঁজে পাই।
ফুটানি থেকে আমরা যখন বের হয়ে না আসতে পারি, তখনই প্রাইসকে ভ্যালুর চেয়ে অগ্রাধিকার পেতে দেখা যায়। ফুটানি মেটানোর জন্য আমরা নানা পথ বেছে নেই। ফলশ্রুতিতে একটি রুগ্ন ব্যাবসায়িক প্রতিযোগিতা ও দৃষ্টিভঙ্গি ফুটানির জোরে সমাজে স্থান করে নেয়। আমরা যদি সত্যিকারের ভ্যালু খুঁজতে পারি, প্রাইসের সঙ্গে ভ্যালুকে সম্পর্কিত করে দেশের অর্থনীতি বা সামগ্রিক উন্নতিকে এগিয়ে নিতে পারি তবে সব স্তরেই উন্নতির ছোঁয়া লাগবে। যে অবস্থাকে আমরা ‘কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট’ বলতে পারি। অন্যদিকে ফুটানি একটি ভাইরাসের মতো এই ‘কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট’ এর উল্টো স্রোতে কাজ করে। ফুটানি উন্নয়নের স্বাভাবিক গতিকেও নষ্ট করে দেয়। একটি ফাইভ স্টার হোটেল থেকে নিম্নমানের খাবার বেশি দামে খেয়ে বের হয়ে মানুষকে দেখাই—দেখো, আমি দামি হোটেলে খেয়েছি। এমন বহু ফুটানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমাজস্থ মানুষের মাঝে। এমন কোনো কথা নেই যে, সবসময় আমাকে চাকচিক্যপূর্ণ রেস্টুরেন্টে খেতে হবে। এখানে ভুল বুঝবার অবকাশ নেই যে, আমি পরিচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে বলছি। পরিছন্নতা এক বিষয় আর চাকচিক্য ভিন্ন বিষয়। রেস্টুরেন্ট বা অন্যকোনো সেবামুলক প্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে চাকচিক্যপূর্ণ হলেও ভেতরে ভেতরে অন্তঃসারশূন্য হতেও পারে। বিষয়টি যাচাই করে দেখার তাদিগবোধ তৈরি হতে হবে।
মানুষ যদি ভ্যালু সচেতন হয় তবে প্রাইস বেশি নেবার যে অসাধু প্রবণতা সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রচলিত আছে, সেটি কমে আসবে। একইসঙ্গে এই ফুটানি নামক বিষয় থেকে যদি আমরা বেরিয়ে আসতে পারি তবে আমাদের সামনে নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে। এই ফুটানি আমাদের আচরণের অংশ। এটি পরম্পরা থেকে হয়, পরিবার থেকে আসে, বন্ধুবান্ধবের সংস্পর্শ থেকেও আসতে পারে। ভ্যানিটির একটি লজিক আছে কিন্তু ফুটানির কোনোরকম লজিক নেই।
ফুটানি শব্দের ইংরেজি বা অন্যভাষার প্রতিশব্দ পাওয়া কঠিন। অন্যভাষা বা সংস্কৃতিতে এই ধারণাই হয়তো নেই যে, আমার যা নেই, সেটি আমাকে প্রমাণ করতে হবে। এই আচরণগত ত্রুটি দূর করতে পারলে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামাজিকভাবে লাভবান হবো আমরা। কখনো এই ফুটানির কাছে পরাজিত হয়ে নিজেরা অধিকদামে কম মুল্যের জিনিস কিনছি, একইভাবে সমাজে বা রাষ্ট্রে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেই বুনিয়াদ গড়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই ফুটানি। যৌক্তিক আচরণের মধ্য দিয়ে প্রাইস ও ভ্যালুর সংঘাত সবসময় মানুষ গুরুত্ব দিয়ে দেখবে এবং ফুটানিকে এড়িয়ে চলবে সেই প্রত্যাশা রাখছি। ফুটানিবিরোধি মানসিকতা গড়ে তুলতে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয় নিয়ে আলাপ হওয়া জরুরি।
(আচরণের অর্থনীতি নিয়ে ১৩ পর্বের ধারাবাহিক লেখার দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ। আগামী সোমবার প্রকাশিত হবে এর তৃতীয় কিস্তি।)
লেখক: পরিচালক, স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।