সিনেমা হলে দর্শক খরা, বিপাকে মালিকরা
- দিবাকার চৌধুরী
একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে এখন প্রায় অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে এর সংখ্যা, পাশাপাশি সিনেমা মুক্তির হারও হ্রাস পাচ্ছে দিন কে দিন । সিনেমা হলের বেহাল দশা, মান সম্মত গল্প না পাওয়া, সময় উপযোগী প্রযুক্তির অভাব ও অপসংস্কৃতির কারনেই দর্শক আজ দেশীয় সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বোধ হয় একেই বলে! গোটা অবস্থা দেখে খুব সহজেই একে চলচ্চিত্রের চরম দুঃসময় বলে আখ্যায়িত করা যায়।
দেশের চলচ্চিত্রের মান মূলত পড়তে শুরু করে ৯০ দশকের পর থেকেই। ভালো গল্পের জায়গায় চলচ্চিত্রে ভর করে অশ্লীলতা। একশ্রেণীর নির্মাতা অশ্লীলতাকে পুঁজি করে যেনতেন রকমের কাহিনীতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই কমতে থাকে দর্শক। বন্ধ হতে থাকে একের পর এক সিনেমা হল। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে দেশের অনেক জেলাতেই নেই মানসম্মত সিনেমা হল।
১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় এ দেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। এরপর পেরিয়ে গেছে ৬০ বছর। হিসাব মতে এখন পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে প্রায় তিন হাজার সিনেমা। সত্তুর ও আশির দশককে এ দেশের চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ বলা হয়। সে সময় সারাদেশে প্রায় তেরোশো সিনেমা হল চালু ছিলো যার মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই ৪৮ টি। কিন্তু দেশের চলচ্চিত্রের আকাশে কালো মেঘ দেখা দেওয়ায় হঠাৎ করেই বন্ধ হতে শুরু করে এসব নামকরা সিনেমা হল। কমতে কমতে এখন এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র সাড়ে চারশ, যার মধ্যে শ’খানেক আবার মৌসুমি।
এক যুগ আগেও শুধু রাজধানীতেই রমরমা ব্যবসা করছে ৫০টি সিনেমা হল কিন্তু সেখানে আজ টিকে আছে মাত্র ১০-১৫ টি হল। অনেকেই আবার লোকসানের ভয়ে সিনেমা হল ভেঙে তৈরি করেছেন বহুতল ভবন কিংবা শপিং সেন্টার। তবে এ মন্দা সময়েও বেশ কয়েকটি নতুন আধুনিক মানের সিনেমা হল তৈরি হয়েছে যার মধ্যে শ্যামলী সিনেমা হল, যমুনা ব্লকবাস্টার, স্টার সিনেপ্লেক্স অন্যতম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব সিনেমা হলে বেশিরভাগ সময় বিদেশি চলচ্চিত্রই দেখানো হচ্ছে। তবে সিনেমা হল বন্ধ হলেও সিনেমা দেখা বন্ধ হয়নি। এখন চায়ের দোকানই হয়ে উঠেছে বিকল্প সিনেমা হল। এছাড়া ইউটিউবে বলিউড, টালিউড, হলিউডের সিনেমা দেখছে বর্তমান প্রজন্ম।
মানহীন সিনেমার কারনেই সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে বলে দাবী করেছেন বিভিন্ন হল মালিকরা। যে সমস্ত হলগুলি এখনও টিকে আছে সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে কিছু ভারতীয় সিনেমা দেখানোয় বিভিন্ন মহলে তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই দুর্দিনে এই পদক্ষেপ দেশের চলচ্চিত্রকে আরো দূরে ঠেলে দিবে বলে অনেকে মতামত দিলেও ব্যবসার স্বার্থে হল টিকিয়ে রাখতে অনেকটা বাধ্য হয়েই এমনটা করতে হচ্ছে বলে জানান হল মালিকরা।
শত হতাশার মাঝেও আশার খবর হচ্ছে, এক সময়ের চরম অশ্লীলতা ও মানহীনতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশে এখন তৈরি হচ্ছে একাধিক মানসম্মত চলচ্চিত্র। ফাগুন হাওয়া, মিশন এক্সট্রিম, অপারেশন সুন্দরবন, ঢাকা অ্যাটাক, গেরিলা, চোরাবালি, থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার, রানওয়ে, টেলিভিশন ও সময়ের সেরা ছবি আয়নাবাজি তারই প্রমাণ। প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে ভিন্ন ধারার একাধিক চলচ্চিত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দাবি হল, সংকটের কারনে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে তাদেরকে; তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ অন্তিম মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোটা বেশ কঠিন হবে বলে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
সময়ের অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকি কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘সিনেমা হল নিয়ে সরকারের নতুন করে ভাবা উচিত। দেশে মানসম্মত সিনেমা হচ্ছে না সেটা বলার আর সুযোগ নেই। প্রতিবছর বেশ কিছু সিনেমা আসছে যা দর্শক লুফে নিচ্ছে। কিন্তু অপর্যাপ্ত সিনেমা হলের কারনে সেভাবে প্রদর্শনের সুযোগ থাকছে না। এখানেই সরকারের সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন। সিনেমার প্রাণ দর্শক ছাড়া সিনেমা হল বাঁচানো সম্ভব না।’
সুস্থ ও অশ্লীলতা মুক্ত ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারলে বাঁচবে সিনেমা হল। নতুন করে মানসম্মত সিনেমা হল তৈরি ও সরকারি উদ্যোগ পেলে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে এদেশের চলচ্চিত্র শিল্প। একই সাথে ভিনদেশি সংস্কৃতিকে যথাসম্ভব দূরে ঠেলে রাখাটাও বাঞ্চনীয়।