একজন ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবনই এক সিনেমা
- শ্রেয়া
বাংলা চলচ্চিত্রের গত শতাব্দি পরিপূর্ণ ছিলো অনেক নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত। তাঁদের মধ্যে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হচ্ছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। সত্তুর দশক থেকে যতদিন অভিনয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন ততদিন অবধি একাধারে বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ছিলেন তিনি।
১৯৫৬ সালের ২৪শে ডিসেম্বরে কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার আশুতিয়াপাড়া গ্রামে জন্ম নেন এই অভিনেতা। তার পিতার নাম হাজি আব্দুল আলী এবং মাতার নাম সরুফা খাতুন। ১৯৭৫ সালে কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে তিনি এইচ এস সি শেষ করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়া শুরু করলেও তা শেষ করেন নি।
কৈশোর জীবন থেকেই তিনি অভিনয়ের প্রতি দুর্বল ছিলেন। এজন্য বেশ কিছু নাট্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে অবশেষে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’ ছবির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে চিত্রনায়িকা ববিতার নায়ক হয়ে আবির্ভাব ঘটে ইলিয়াস কাঞ্চনের। তিনি ৩০০ টিরও বেশি সিনেমায় কাজ করেছেন। তার অভিনীত ১৯৮৯ সালের সিনেমা “বেদের মেয়ে জোছনা” এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সব্বোর্চ ব্যবসা সফল এবং কালজয়ী চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে।
ইলিয়াস কাঞ্চন রোমাণ্টিক, অ্যাকশন, কমেডিয়ান সব ধরণের চরিত্রে পর্দার সামনে নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর অভিনয় দিয়ে তিনি জয় করেছেন কোটি কোটি ভক্তের মন। চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছ থেকে তিনি সুপারস্টার” খেতাব পেয়েছিলেন।
বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনে পত্রিকা ‘চিত্রালিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, চলচ্চিত্র অভিনয় শুরুর পর অনেক দিন তাঁর বাবা-চাচারা উনার সঙ্গে কথা বলেনি। তবুও সুপারস্টার কাঞ্চন চলচ্চিত্রে অভিনয় করা থেকে সরে আসেননি। এক সময় পরিবার মেনেও নেয়।
১৯৭৯ সালে ইলিয়াস কাঞ্চন জাহানারা কাঞ্চনকে বিয়ে করেন। তাঁদের একমাত্র পুত্রের নাম মীরাজুল মঈন। ১৯৯৩ সালের ২২শে অক্টোবর ইলিয়াস কাঞ্চনের চলচ্চিত্রের শুটিং দেখার জন্য বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং মাঝপথে চট্টগ্রামের অদূরে চন্দনাইশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এরপরই ইলিয়াস চলচিত্রের জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন।
১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর ‘ নিরাপদ সড়ক চাই’ নামের সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন, যে সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা; এবং তিনি এখনো নিজেকে এই আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত রেখেছেন। তিনি বর্তমানে “নিরাপদ সড়ক চাই”( নিসচা) সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রধান কান্ডারি। ‘নিসচা’ আন্দোলন বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং তার সাথে সাথে বিভিন্ন মহল একাত্মতা ঘোষণা করেছে।
ইলিয়াস কাঞ্চন ২০১৫ সালের ৪ই মে জাতিসংঘের রোড “সেফটি ফর আওয়ার চিলড্রেন” কর্মসূচিতে অংশ নেন। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল, কাকরাইল খিলগাঁও, উত্তরা এবং ধানমন্ডির পাঁচটি স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাথে নিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করেন। এই কর্মসূচির মূল স্লোগান হচ্ছে- “ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ সড়ক চাই।“ এই আন্দোলনের জন্য তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।
২০১২ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার সেগুনবাগিচায় অনুষ্ঠিত একটি সংবাদ সম্মেলনে তারা ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান। ২০০২ সালে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ছবি: নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন
ইলিয়াস কাঞ্চন ১৯৮৬ সালে এবং ২০০৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০১৮ সালে একুশে পদক এবং ২০১৮ সালে টেলিভিশন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ট্রাব) পুরস্কার অর্জন করেন। ২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি শিল্পী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি সময়ের সেরা মানুষগুলোর অন্যতম একজন হচ্ছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।তিনি তাঁর অভিনয়ের পাশাপাশি নিসচা’র(নিরাপদ সড়ক চাই) আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেকে কিংবদন্তীর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।