ইন্টারস্টেলার : মহাকাশের মহাযাত্রা!
- মেহেরাবুল হক রাফি
টিক! টিক!! টিক! টিক!!
যেকোনো দেয়াল-ঘড়ির সামান্য এই শব্দও যে মানুষের গায়ের লোম খাড়া করে দিতে পারে সেটি হয়ত ‘ইন্টারস্টেলার’ না দেখলে কেউ বুঝতেও পারবে না। সামান্য এক সায়েন্স-ফিকশন সিনেমা কীভাবে দর্শকদের পঞ্চইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করতে পারে তার যথার্থ উদাহরণ ক্রিস্টোফার নোলানের অমর সৃষ্টিটি।
হালের সেরা পরিচালকদের তালিকা করলে নোলানের নাম সেখানে বেশ ওপরের দিকেই থাকবে। শৈশবে বাবার সাথে সিনেমা হলে গিয়ে দেখা তাঁর প্রথম মুভিটি ছিলো স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘২০০১: আ স্পেস ওডিসি’। প্রথম দর্শনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে বড় হয়ে স্পেস ওডিসির মতো সিনেমা বানাবেন। নিজের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ফলোয়িং’ রিলিজের আগেই ছোট ভাই জোনাথন নোলানের সাথে মিলে লিখে ফেলেন ইন্টারস্টেলারের চিত্রনাট্য। আর তারও প্রায় দুই যুগ পর স্বপ্ন পরিণত হয় সত্যিতে।
ইন্টারস্টেলারের গল্প শুরু হয় নিকট ভবিষ্যতে আমেরিকার এক অঞ্চল থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সেসময়ে কৃষি চাষবাসও হয়ে উঠেছে দুরূহ। দুনিয়ার বড় বড় বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আর কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। সে লক্ষ্যে নাসা মহাকাশে খুঁজে বেড়াচ্ছে নতুন কোনো আবাসস্থল। বুড়ো বাবা আর ছেলে টম এবং মেয়ে মার্ফকে নিয়ে ছোট্ট সংসার বর্তমানে ভুট্টোর চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে বেড়ানো কুপারের। তরুণ বয়সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যুক্ত থাকলেও পরিস্থিতি কুপারকে বাধ্য করেছে শেকড়ের নিকট ফিরে যেতে। এতোকিছুর মাঝে হটাত তাঁর ডাক পড়ে এক সিক্রেট মিশনে যাওয়ার, যে মিশনের ওপর নির্ভর করছে মানবজাতির ভবিষ্যত। কি-ইবা সেই মিশন? আর কেনই-বা তার জন্য বেছে নেওয়া হলো কুপারকে? এসব প্রশ্নের উত্তরই খোঁজা হয়েছে পুরো মুভিজুড়ে।
প্রায় দেড় শ মিলিয়ন ডলার বাজেটে নির্মিত ইন্টারস্টেলারের প্রডিউসার হিসেবে কাজ করেছে খোদ ক্রিস্টোফার নোলান এবং ওয়ার্নার ব্রোস। ডার্ক নাইট ট্রিলজি কিংবা ইনসেপশনের বক্স অফিস সাফল্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। চিরাচরিত জিমার-নোলান জুটির দেখা মিলবে এখানেও। কসমসের স্বর্গীয় শব্দকে হ্যান্স জিমারের মতন এতোটা নিখুঁতভাবে আর মনে হয় না কেউ পর্দায় তুলে ধরতে পারত। ব্ল্যাক হোলের চিরনৈশব্দতা থেকে শুরু করে কুপারের কান্না; সবখানেই নিজের মুনশিয়ানার পরিচয় রেখেছেন তিনি। নোলান ব্রাদার্সের যৌথ চিত্রনাট্যের বৈজ্ঞানিক বিষয়াদি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ক্যালটেকের প্রফেসর কিপ থর্ন; যিনি পরবর্তীতে ২০১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
৮৭তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের আসরে ভিএফএক্স, অরিজিনাল স্কোর, প্রোডাকশন ডিজাইনিং, সাউন্ড মিক্সিং এবং সাউন্ড এডিটিং বিভাগে অস্কারের জন্য মনোনীত হয় ইন্টারস্টেলার। এরমধ্যে ভিএফএক্স ক্যাটাগরিতে সোনালী মূর্তিটি যায় নোলান অ্যান্ড কোংয়েরই দখলে। দেড় শ মিলিয়ন ডলার বাজেটের বিপরীতে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেট থেকে প্রায় আটশো মিলিয়ন ডলার আয় করে ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইন্টারস্টেলার। ফলে নোলানের উপর ওয়ার্নার ব্রোসের আস্থা বেড়ে যায় বহুগুণে। যার বদৌলতে ক্রিস্টোফার নোলানের পরবর্তী দুই সিনেমা-ডানকার্ক এবং টেনেট, মুক্তি পায় তাদের ব্যানারে। এছাড়া গত দশকে সাই-ফাই মুভির মার্কেটিংয়ের দিক থেকে একটি মাইলফলক হিসেবে রয়ে যাবে ইন্টারস্টেলার এবং সেই বিপণন কৌশল অনুসরণ করেই বিগত কয়েক বছরে সাফল্যের দেখা পেয়েছে ব্লেড রানারঃ ২০৪৯ কিংবা ডুনঃ পার্ট ওয়ানের মতন নতুন ধ্যান-ধারনার সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্রসমূহ।
তবে এতোকিছুর পর ইন্টারস্টেলারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হয়তো কুব্রিকের আ স্পেস ওডিসির সাথে একই বাক্যে নাম উচ্চারিত হতে পারাটা। ষাটের দশকে কুব্রিক যেমন তাঁর সেরা সৃষ্টি দিয়ে হলিউডের প্রচলিত সকল নিয়ম-কানুন ভেঙে দিয়েছিলেন, নোলানও ঠিক তেমনটাই করে দেখিয়েছেন ইন্টারস্টেলারের মাধ্যমে। তাই তো সাই-ফাই এখন আর সস্তা বিনোদনের কোনো মাধ্যম নয়, বরং জীবন দর্শন চিত্রায়ণের অন্যতম এক বড় ক্ষেত্র।