বাঙালি মুসলিম অভিনেত্রীদের পথ পদর্শক বনানী চৌধুরী
- সানজিদা আক্তার
বর্তমানে বাংলায় অগনিত মুসলিম অভিনেত্রী থাকলেও এক সময় তা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। যে সময় মুসলিম নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারত না সে সময়ে সপ্নকে বাস্তবায়ন করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছিল বনানী চৌধুরী। এই দুঃসাহসী নারীই বাংলার প্রথম মুসলিম অভিনেত্রী। তাই তো বলা হয় বাঙালি মুসলিম অভিনেত্রীদের পথ প্রদর্শক বনানী চৌধুরী।
বাংলার প্রথম মুসলিম অভিনেত্রী বনানী চৌধুরী হিসেবে পরিচিত থাকলেও তার প্রকৃত নাম হচ্ছে বেগম আনোয়ারা নাহার চৌধুরী লিলি। মূলত অভিনয় জগৎ এর কারণেই তিনি নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। মুসলিম হয়েও হিন্দু ধর্মের নাম গ্রহনের কারণ হচ্ছে এর ফলে কম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হবে। তখনকার সমাজের মানুষ তাকে একজন মুসলিম অভিনেত্রী হিসেবে জানলে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হতো। তাই সবাই যেন তাকে হিন্দু ধর্মের ভাবেন এবং প্রথম মুসলিম অভিনেত্রী হিসেবে কম প্রতিবন্ধকতা আসে সেই জন্যই বেছে নেন এই পন্থা।
বনানী চৌধুরী ১৯২৪ সালের মে মাসে ভারতের বনগাঁ, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বনানী চৌধুরী ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও তার পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের মাগুরা জেলার, শ্রীপুর থানার সোনাতুনদি গ্রামে। পিতার চাকরির সুবাদে তার ভারতে জন্ম এবং শিক্ষাজীবন শুরু হয় ভারতের মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘী গ্রামের একটি স্কুল থেকে।
লিলি থেকে বনানী চৌধুরী হওয়ার মূল অনুপ্রেরণা হচ্ছে তার স্বামী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রাজুর। স্বামী ও তার দুই বন্ধু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুলতান আহমেদের অনুপ্রেরণায় সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে পেরেছে বনানী চৌধুরী। বনানী চৌধুরীরা নয় ভাই বোন ছিলেন এবং মাত্র অষ্টম শ্রেণি থাকাকালীন বিয়ে হয় তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে।
বিয়ে হলেও বনানী চৌধুরী পড়ালেখা চালিয়ে যান । ছোটবেলা থেকেই বনানী চৌধুরীর অভিনয়ের প্রতি ছিল অন্যরকম ভালবাসা। তিনি স্কুল ও কলেজে থাকাকালীন বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও অভিনয় করেছেন। তবে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন তার লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর। তার প্রথম ছবির নাম হচ্ছে “বিশ বছর আগে”। তবে ছবিটি মুক্তি পেতে দেরী হওয়ার এর আগেই তিনটি সিনেমাতে দেখা পাওয়া যায় তাকে। সিনেমা তিনটির নাম হচ্ছে ‘অভিযোগ’, ‘পূর্বরাগ’ এবং ‘তপোভঙ্গ’।
বনানী চৌধুরী শুধুমাত্র প্রথম বাঙ্গালী মুসলিম অভিনেত্রী বলে বিখ্যাত নয় বরং তিনি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার অভিনয়ও বেশ প্রশংসনীয়। তার অপরুপ চোখ এবং হাসি দেখে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবে। মায়াজাল, বিষের ধোঁয়া, মায়াজাল, পরশ পাথর, নন্দরামের সংসার, অভিযোগ সহ রয়েছে তার জনপ্রিয় সিনেমা। এমনকি জহির রায়হান, নীতির বসু, আর হেমেন গুপ্ত সহ বিখ্যাত পরিচালকের সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল। এছাড়াও তৎকালীন উচ্চশিক্ষত অভিনেত্রী ও উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে। বনানী চৌধুরী কলকাতার বেতার ও মঞ্চের সাথেও সংযুক্ত ছিলেন।
বনানী চৌধুরীর অভিনয় জগৎ এ যাত্রা ভারতের সিনেমার মাধ্যমে হলেও শেষ বয়সে বেশ কয়েকটি সিনেমাতেই দেখা মেলে তার। বাংলাদেশের “বদনাম” ছবিতে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করার পর প্রশংসা এবং আলোচনার শীর্ষে ছিলেন তিনি। বনানী চৌধুরীকে একজন ভাগ্যবতী মহিলা বললেও ভুল হবে না।কেননা তিনি সংসার জীবনেও পেয়েছিলের এক অসাধারণ জীবন সঙ্গী। তাই তো তার স্বামীর মৃত্যুতে বনানী চৌধুরী একাকীত্ত্বে ভোগেন। বনানী চৌধুরীর স্বামীর মৃত্যুর ৩০/৩৫ মধ্যে তিনিও মারা যান। তাদের পানু এবং বুলেট নামে দুই সন্তান ছিল। তবে তাদের কেউই বেঁচে নেই।
বনানী চৌধুরী ১৯৯৫ সালের ৫ জানুয়ারি ঢাকাতে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। কিংবদন্তী বনানী চৌধুরী মৃত্যুবরণ করলেও তার দুঃসাহসী কাজের মাধ্যেমে আজও বেঁচে রয়েছে আমাদের মাঝে। হয়তো তিনি না থাকলে আজও অভিনয় জগতে বাঙালি মুসলিম নারীর অবস্থান দেখা মিলত না।