বাংলা সিনেমা পাড়ার বিস্ময়কর সৃষ্টি সত্যজিতের ‘অপু’
- আবু রিফাত জাহান
বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন সত্যজিত রায়, তখনও অপুর সংসার নির্মাণের কথা চিন্তা করেন নি। কিন্তু ইতোমধ্যে বাংলার প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এর উপন্যাসের উপর সত্যজিত তার প্রথম দুটি সিনেমা ‘পথের পাঁচালী'(১৯৫৫) ও ‘অপরাজিত'(১৯৫৬) নির্মানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সমাদৃত হচ্ছেন। এরপরেই ১৯৫৮তে ‘অপু ত্রয়ী’ বা ‘অপু ট্রিলোজি’র শেষভাগের কাজ ধরলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে ‘অপুর সংসার’ বের হওয়ার পর সিনেমাপাড়ার সাথে সাথে ভারতীয় পুরো শিল্প-সাহিত্যেই অভাবনীয় পরিবর্তন শুরু হয়।
সত্যজিত ‘অপুর সংসার’ সিনেমার জন্য যে অপুকে সৃষ্টি করলেন, সে অপু বিভূতিভূষণের ‘অপরাজিত’ উপন্যাস থেকে একদম ভিন্ন প্রবাহে এগিয়ে গেছে। উপন্যাসের ‘অপু’র চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, সত্যজিত রায়ের অদ্ভুত সুন্দর শিল্পদৃষ্টি। বাংলা সিনেমার সাথে ইটালিয়ান নিওরেলিজমের কি চমৎকার সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন সত্যজিত। মূলত, ভারতের তৎকালীন জীবনের বাস্তবচিত্রকে নাটকীয়তায় মাধ্যমে তুলে ধরাটা এবং জীবন দুঃখ, কষ্ট, প্রেম, ভালোবাসা সহ সকল আবেগের অসাধারণ সমন্বয় করেছেন সত্যজিত।
এই ট্রিলজি এর প্রথম খন্ডে অর্থাৎ ‘পথের পাঁচালী’তে অপুর একদম ছোট বেলার চিত্র তুলে ধরে, যেখানে তার হতদরিদ্র, শিক্ষিত ও ভদ্র বাবা সংসার চালাতে হিমশিম খায়। হঠাৎ একদিন মহামারিতে নিজের বড় বোন দুর্গাকে হারানোর পর স্বপরিবারে গ্রাম থেকে শহরের দিকে চলে আসেন অপুরা। একক সন্তান হিসেবে বড় হতে থাকে অপু; প্রথমে বেনারস, তারপর কলকাতা এমনি করে বিভিন্ন শহরে। পরিচালক সত্যজিত রায় অপুর এই ছোটবেলার বেড়ে উঠাকে খুব ধীরতার সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, বিশেষ দরিদ্রতার ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলতে সিনেমাটি খুব ধীরে ধীরে চিত্রনাট্য পরিবর্তন করেছে।
ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ডে অর্থাৎ ‘অপরাজিত’তে অপু তার কিশোর বয়সকে পাড়ি দিচ্ছে। ছোট্ট দুরন্ত সে অপু এখন আর আব্দার নয় বরং হঠাৎ একদিন বাবা হারানোর পর আবার মা সহ অসহায় হয়ে পড়েন। এখানে সেখানে কত জায়গায় তারা আশ্রয় নেয়। তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজে সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে একক মায়ের সংসারে লক্ষী ছেলে অপুর ভেতর পড়াশোনার ব্যাপার ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সিনেমায় মায়ের চরিত্র করুণা বন্দোপাধ্যায় আর কিশোর অপু স্মরণ ঘোষালের মধ্যকার মা-ছেলের চমৎকার কেমিস্ট্রির চিত্রায়ণ কেবল সত্যজিতই এভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা দেবীকে আবিষ্কারও ‘অপু ত্রয়ী’র মতো বাংলা সিনেমা ইতিহাসের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। সত্যজিত তার সিনেমায় সবসময়ই নতুনদের প্রাধান্য বেশি দিয়েছেন। অভিনেতা হিসেবে প্রথমবারের মতো স্ক্রিণে সৌমত্রের কাজ এক কথা বাজিমাত বলা যায়। আর শর্মিলা দেবী তার প্রথম সিন; বিয়ের পরে প্রথমবার স্বামীর মুখোমুখি হয় -এই দৃশ্যের মাধ্যমে সিনেমাপাড়ায় নাম লেখায় যখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর। এই দুই নতুন মুখকে নিয়েই সত্যজিত করে দেখালেন অসাধ্য। বানালেন বাংলার ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র আর পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা ট্রিলজি। উপন্যাসের বেড়ে উঠা অপুর হিসাব বাদ দিয়ে বরং একদম উদাসীন টাইপ এক অপু, যে কিনা লেখালেখি বাদে আর কোনো উদ্দ্যেশ্য নিয়ে ঘুরে না বরং জীবনটাকে সে তার মতো উপভোগ করে বেড়ায় শত অভাব সত্ত্বেও। এই অপু বাংলার অসংখ্য নওজোয়ানদের সেসময় বাঁচতে শিখিয়েছে অভাব আর হতাশা থেকে। জীবনটাকে সুন্দর করতে প্রয়োজন সুন্দর স্বপ্ন এমনটাই সত্যজিত তার অভিনয়ে বারংবার বার্তা দিয়ে গেছেন।
এই ট্রিলজিকে যে সব কারণে আপনাকে সেরা মানতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো অপু আর অপর্ণার বিয়ে এবং সংসার জীবন। অপু আর অপর্ণার মাত্র ২০ মিনিটের স্ক্রিণটাইমে তাদের অভিনয় আর সত্যজিত বাবুর অসাধারণ নির্দেশনায় এউ সিনেমাটি যুগ যুগ ধরে ভালোবাসার প্রতীকি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে উপমহাদেশিয় সাহিত্যে।
সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অপর্ণার বিয়োগ অপুর জীবনের সব না পাওয়া, সব হারানোর মতো হতাশাগ্রস্ত করে তুলে। সে নিজে থেকে হয়ে উঠে নিসঙ্গ। ছেলের মুখোমুখি হতে চায়নি কোনোদিন, পালিয়ে বেড়িয়েছে নিজের অস্তিত্ত্ব থেকে। অথচ কি চমৎকার ভালোবাসার খুনসুটি, ছোট ছোট সংলাপ, মান অভিমানে ঘেরা তাদের সংসারে কতই না জীবন্ত ছিল অপু। সিগারেট খাওয়া নিয়ে স্বামী স্ত্রীর বন্ধু সুলভ খুনসুটি পরবর্তী অনেকগুলা প্রজন্মের জন্য বাংলায় ভালোবাসার নিদর্শন হয়ে উঠে। অপু-অপর্ণার প্রত্যেকটি সিন ছিল চমৎকার রোমান্স আর আত্মজীবনীতে ভরপুর। সেই সিনেমা অপর্ণার ত্যাগে হঠাৎ আবার ধীর গতিতে এগিয়ে যায় ঠিক যতক্ষণ না বাবা অপুর সাথে ছেলে কাজলের স্ক্রিনে একাত্মতা না হয়। এ যেন পথের পাঁচালী’র সেই ছোট্ট অপুর শুরু করে অপুর সংসার’-এর ছোট কাজলের মাধ্যমে সিনেমার সমাপ্তি টানা, যা একটু পূর্ণ জীবন চক্রকেই নির্দেশ করে যায়।
বংশী সেন গুপ্ত আর সুব্রত মিত্রকে নিয়ে সত্যজিত রায় গড়ে তুলেছেন অপুর জন্য একেকটি সেট, যা কোনো না কোনো ভাবে তার পূর্ববর্তী কোনো কাহিনীর সাথে সামান্য পরিমাণে অনুভূতির স্পর্শ করে গেছে, বিশেষ করে সেই ট্রেনের দৃশ্য কিংবা অসাধারণ মিউজিকের মাধ্যমে সিনেমায় অপু ও তার ছেলের কাজলের মিলনের মধ্যে দিয়ে যে সানাইয়ের সুর বেজে উঠে, একই সুর দর্শকদের জন্য পরিচিত যখন অপুর বোন দুর্গাকে হারিয়ে তার বাবা-মা ভাঙা ঘরের বারান্দায় বসে কান্না জুড়ে দেয়। কোথা থেকে কি অসাধারণ সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন সত্যজিত রায়, যা তাকে যুগে যুগে স্যালুট জানায় সিনেমা বিশারদরা।
চিত্রগ্রাহক হিসেবে সুব্রত মিত্র ও পরিচালক সত্যজিত রায়ের সমন্বয় কত অসাধারণ ছিল, তার দেখা মেলে সেই ষাটের দশকে সিনেমাটোগ্রাফির মাধ্যমে বাংলা সিনেমাপাড়াকে হতচকিত করে দেয়ার মতো কাজ করে। যেই মূহুর্তে অপু তার লেখালেখির খাতা ছিঁড়ে আকাশে উড়িয়ে দেয়, কিংবা দুর্গার দেহত্যাগের দৃশ্য কিংবা অপু-দুর্গার দুই ভাইবোনের গ্রাম থেকে দূরে শহুরে প্রাণের স্পন্দন পাওয়ার দৃশ্যের মতো অসংখ্য ছোট ছোট সিনেমা স্ক্রিণে আপনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাবেন সিনেমাটোগ্রাফির কাজ দেখে।
আর এই সব কিছু নিয়েই সত্যজিত হয়ে উঠেছেন বাংলা সিনেমাপাড়ার অপুর স্রষ্টা। যেখানে সিনেমার চিত্রনাট্যের চেয়েও বাস্তব জীবননাট্যকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। আর সাথে সত্যজিত রায়ের কল্পণাপ্রসূত অসাধারণ সব ছোট ছোট দৃশ্যের অবতারণা অপু ত্রয়ীকে করে তুলেছে অবিনশ্বর। বাংলা সিনেমার এক অধ্যায়ের শুরু যেমন এই অপুর কাঁধে চড়ে যাত্রা শুরু করে, সেই সিনেমাপাড়াই এখনো অপুকে মডেল করে সিনেমা চিত্রনাট্য তৈরি করে চলেছে। আর তাই অপু ত্রয়ীর অপু তাই অসাধারণ এক সৃষ্টি হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে থাকে।