তরুণরা বদলে দিচ্ছেন কৃষি
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
ছিল পরিত্যক্ত জমি। ছোট-বড় পাহাড়ের টিলা। ঝোপ-ঝাড়ে ঘেরা ছোট ছোট গজারির বন। মাটিতে এসিডের পরিমাণও বেশি। সব ধরনের ফসল ভালো হয় না। কেউ ভাবেনি এমন পরিত্যক্ত জমিতে চাষ করা যাবে, এখানেও সোনা ফলবে। কৃষি পাগল বাবুল মিয়ার উদ্যোগ পাল্টে দিয়েছে সব দৃশ্যপট।
ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার উথুরা ইউনিয়নের হাতিবেড় গ্রামটি ছোট-বড় টিলায় ঢাকা। নীচু জমিতে ধানের চাষ হলেও টিলার উপরে ঝোপ-ঝাড়ে ঘেরা গজারি বন। ওই গ্রামের এক টগবগে তরুণ বাবুল মিয়া। পড়ছেন টঙ্গী সরকারি কলেজে। সমবয়সী তরুণরা যখন মরিয়া হয়ে চাকরি খুঁজছেন, কেউবা জমি-জমা বিক্রি করে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন এই তরুণ দেখলেন এক ভিন্ন স্বপ্ন। কিভাবে পরিত্যক্ত জমি কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বি হওয়া যায়।
তখনও কৃষি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা নেই বাবুল মিয়ার। চাষ পদ্ধতি কিভাবে হবে, কোথায় ভালো বীজ মিলবে, কিভাবে এই পরিত্যক্ত জমি চাষের আওতায় এনে স্বাবলম্বি হওয়া যাবে- এমনসব নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এই তরুণের মাথায়। পরামর্শ নিলেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার কাছে। ভালো বীজের জন্য আলাপ করলেন স্থানীয় বীজ বিক্রেতার কাছে। সবার সঙ্গে পরামর্শ শেষে সবজি চাষে আগ্রহী হন।
প্রথমেই পরিত্যক্ত ১০ একর জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসেন। এজন্য তাকে বেশ খাটুনি খাটতে হয়েছে। খরচও হয়েছে বেশি। বাবুল মিয়া বলেন, ১০ একর পরিত্যক্ত জমি চাষের উপযোগী করে লাউ চাষ করতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৮ লাখ টাকা। তবে এরই মধ্যে ১০ লাখ টাকার লাউ বিক্রি করেছেন। আরো দুই মাস লাউ বিক্রি করতে পারবেন, যা থেকে আরো ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় হবে বলে আশা করেন তিনি।
জমি চাষের উপযোগী করে তুলতে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে ধলোচুন ব্যবহার করেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজ আজম বলেন, এই এলাকার মাটিতে এসিডের পরিমাণ বেশি। তাই সব ধরনের ফসল ভালো হয় না। তবে ধলোচুন ব্যবহার করলে মাটির এসিডটি কমে। তখন মাটি সবজি চাষের উপযোগী হয়ে ওঠে।
স্থানীয় বীজ বিক্রেতা মো. আলাল মিয়ার কাছ থেকে ‘মম’ জাতের বীজ সংগ্রহ করেন। নিজেই চারা তৈরি করেন। তরুণ উদ্যোক্তা বাবুল বলেন, ‘মম’ জাতের বীজটি নিয়ে বেশি লাভবান হয়েছি। চাষ করতে গিয়ে কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়নি। ফ্রুট ফ্লাই এর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে ‘সেক্স ফেরোমেন ট্রাপ’ ব্যবহার করেছি।
স্নাতক পড়ুয়া এ শিক্ষার্থী এখন নিজেই উদ্যোক্তা। নিজ ক্ষেতের পরিচর্যা করতে প্রতিদিন দশজন লোক খাটান তিনি। ক্ষেত থেকে দিনে প্রায় ৫৫০টি লাউ তোলেন। স্থানীয় বাজারে তুললে প্রতিটি লাউ পাইকারি বাজারে ২৭ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়।
ঢাকায় বাজার ভালো থাকলে অনেক সময় পাইকাররা আগাম অর্ডার দিয়ে রাখেন। লাউ সংগ্রহ করতে অনেক সময় পাইকাররা বাবুলের ক্ষেতেই চলে আসেন। অসুবিধা একটাই। সেচের সমস্যা। বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকার কারণে ডিজেল পুড়ে সেচ দিতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়, জানান বাবুল।
এলাকার সব বয়সীদের কাছে বাবুল মিয়া এখন হাতিবেড় গ্রামের মডেল। লাউ চাষে তার সাফল্য এলাকায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। অনেক বেকার যুবক এখন বাবুলকে অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। তারা বাবুলের কাছে আসছেন, তার সফলতার গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইসহাক আহম্মেদ বলেন, বাবুল চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফল হয়েছেন। গ্রামের বেকার যুবকরা বাবুলকে অনুসরণ করলে একদিকে যেমন বেকারত্ব কমবে অন্যদিকে তরুণদের হাত ধরে দেশটাও পাল্টে যাবে। এই তরুণ আরো বলেন, স্বল্পসুদে ঋণ পেলে আগামী বছর আরো বড় পরিসরে জায়গা নিয়ে চাষ করতে পারবো।
বাবুলকে এ কাজে সহযোগিতা করছেন উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো, কামরুজ্জামান বলেন, বাবুল মিয়াকে চাষের কাজে আমরা সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
গেটকো এগ্রো ভিশন লিমিটেড এর চিফ অপারেটিং অফিসার মো. আব্দুস সামাদ মন্ডল বলেন, ‘মম’ জাতের বীজটি আমাদের নিজস্ব গবেষণার ফসল। এর প্রধান গুণ হল, প্রতি গিঁটে গিঁটে ফল ধরে। ফলে উত্পাদন বেশি হয়। এছাড়া এ জাতের লাউ সারা বছর চাষ করা যায়। খেতেও সুস্বাদু।