বিসিএস পরীক্ষা : বাংলা-ইংরেজি বিতর্ক
- ওমর রাদ চৌধুরী
বিসিএস পরীক্ষায় বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ রাখা নিয়ে সম্প্রতি একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা, ২০১৪-এর ২১ নং বিধিতে ‘পরীক্ষায় উত্তরদানের ভাষা’ শিরোনামে বলা হয়েছে: ‘কমিশন ভিন্নরূপ নির্দেশনা প্রদান না করিলে একজন প্রার্থী তাহার লিখিত পরীক্ষার উত্তর বাংলা অথবা ইংরেজি যে কোনো একটি ভাষায় প্রদান করিবেন’।
কমিশন জানিয়েছে যে, আগামী বিসিএস পরীক্ষা (৩৮তম বিসিএস) থেকে বাংলার পাশাপাশি তারা ইংরেজিতেও একই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবে এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বিসিএস-এ আগ্রহী করে তুলতে এবং প্রশাসনে ইংরেজিতে দক্ষ জনবলের ‘ঘাটতি’ কমাতে তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। (‘ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে চায় কর্তৃপক্ষ’, বিবিসি বাংলা, ১৩ই মার্চ, ২০১৭)
ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব সর্বজনবিদিত এবং এই গুরুত্ব নতুন করে প্রমাণ করার দরকার নেই। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজির বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফলে ইংরেজি জানা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। তবে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের আসলে এমন কর্মকর্তা দরকার যিনি বাংলাতেও দক্ষ। বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষাতেই দক্ষতার পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলেই সরকার সবচেয়ে যোগ্য কর্মকর্তাদের পাবে। এই প্রসঙ্গে পিএসসির এই ২১ নং বিধি বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়, যেগুলোর উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। যদি পিএসসি ইংরেজিতে দক্ষ জনবলই চায় তাহলে কি যিনি ইংরেজিতে পরীক্ষা দেবেন তার প্রতি কোনো ধরনের পক্ষপাত করা হবে? যদি করা হয়ে থাকে তাহলে কি দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণির যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে ইংরেজিতে “উচ্চতর দক্ষতা” অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন, তারা কি বেশি সুবিধা পাবেন? আর দেশের বাকি বিপুল জনগোষ্ঠী যারা বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং যাদের কখনোই সেই অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিলো না ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করার, তারা বিসিএস পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন?
ইংরেজিতে যিনি পরীক্ষা দিচ্ছেন, ২০০ নাম্বারের বাংলা পরীক্ষা দিয়ে কি তার বাংলা জ্ঞান যাচাই করা যাবে? বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের কিন্তু ২০০ নাম্বারের ইংরেজি পরীক্ষা ঠিকই দিতে হয়। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, সরকার ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বিসিএস-এ আকৃষ্ট করতে চায় ভালো কথা! কিন্তু তাদেরকে বিসিএস-এ বাংলাভাষা জ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হবে।
ইংরেজিতে পরীক্ষা দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হবেন অর্থাৎ ক্যাডার হবেন, ভালো বাংলা না জানা থাকলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে কীভাবে তারা বাংলা ব্যবহার করবেন? সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলন আমাদের জাতীয় অগ্রগতির জন্য জরুরি জেনেও আমরা এতদিনেও তা করতে পারিনি। বাংলায় অদক্ষ কর্মকর্তারা কি পারবেন সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনে ভূমিকা রাখতে? ব্যাপারটা শুধু বাংলা প্রচলন নয়। একজন জুনিয়র আমলার কার্যক্রমের প্রধান অংশই সাধারণ মানুষের সঙ্গে। সেখানে বাংলাই ভরসা, বিশেষ করে দাপ্তরিক লেখালেখির ক্ষেত্রে। বাংলায় অদক্ষরা হয়তো তখন করণিকদের উপরেই পুরোপুরি নির্ভর করবে।
ইংরেজিতে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ এবং পিএসসির ইংরেজি-প্রীতি ভবিষ্যতে বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে দিতে পারে। ভারতের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় একজন প্রার্থী তাদের সংবিধানে স্বীকৃত ২২টি ভাষার যেকোনো একটিতে বা ইংরেজিতে পরীক্ষা দিতে পারেন। উত্তীর্ণ হতে হলে আলাদা করে যেকোনো একটি আঞ্চলিক ভাষার পরীক্ষায় (প্রার্থীর নিজের ভাষা বা অন্য কোনো ভাষা) প্রার্থীকে পাস করতে হয়। মনে রাখতে হবে ইংরেজি ভারতের দাপ্তরিক ভাষা। তারপরও তাদের ইংরেজির যে বাধ্যতামূলক পরীক্ষাটি হয় সেটির নম্বর প্রার্থীর পরীক্ষার মোট নম্বরের সঙ্গে যোগ হয় না, শুধু দেখা হয় প্রার্থী সেটিতে পাস করেছে কিনা। ২০১১ সাল থেকে ভারতের UPSC (Union Public Service Commission) যেকোনো একটি আঞ্চলিক ভাষায় পাস করার প্রয়োজনীয়তার নিয়ম তুলে দেয় এবং ইংরেজির নাম্বার মোট নাম্বারের সঙ্গে যোগ করার নিয়ম করে। স্নাতক পর্যায়ে আঞ্চলিক ভাষায় পড়াশোনা না করলে এবং ঐ ভাষার কমপক্ষে ২৫ জন পরীক্ষার্থী না থাকলে ঐ আঞ্চলিক ভাষায় পরীক্ষা দেয়া যাবে না এই নিয়মও করা হয়। অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষাগুলোতে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ সংকুচিত করে আনা হয়। ফলে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বেশি সুবিধা পেয়ে যান, যেহেতু তাকে কোনো ভারতীয় ভাষাতেই পাস করতে হয় না এবং ইংরেজির নাম্বার তার মোট নাম্বার বাড়িয়ে দেয়। এর ফল হয় ভয়াবহ। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে ২০০৯ সালে যেখানে শতকরা ২৫ শতাংশ ছিল হিন্দী মাধ্যমের সেখানে ২০১৪-তে এসে সেই পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র তিন শতাংশে (যাদব য. ২০১৪, ‘এন্ড দা উইনার ইজ ইংলিশ’, দা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৪ আগস্ট)। ২০১৪ সালেই এইসব সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হয় এবং ভারত সরকার এগুলোর সবই প্রত্যাহার করে। আমাদের দেশে ২১ ধারার সঙ্গে ২০১১ সালের ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সংস্কারগুলোর মিল পাওয়া যায় এবং একই পরিণতি যে আমাদের দেশেও ঘটবে না তার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সেকেণ্ড ল্যাংগুয়েজে পরীক্ষা দেয়া বাধ্যতামূলক বলে খোদ ইংরেজরাই সমস্যায় পড়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশন কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র ১.৮ শতাংশ ব্রিটিশ, কারণ ব্রিটিশরা অন্য ভাষা চর্চায় পিছিয়ে রয়েছে (‘ব্রিটেন ইন ল্যাংগুয়েজ ব্যাটল ওভার ই.ইউ সিভিল সার্ভিস এক্সামস’, দা টেলিগ্রাফ, ১ জুলাই ২০১০)। এই নিয়ে ব্রিটেন প্রতিবাদ জানালে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ২০১১ সাল থেকে নিয়ম করে যে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা মাতৃভাষায় দেয়া যাবে। অর্থাৎ, শুধু ভাষার কারণে বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে। ভাষাকে শুধু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে না দেখে মেধার মানদণ্ড হিসেবে দেখলে এই সমস্যা হবার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে পিএসসি সেই পথেই হাঁটছে কিনা।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: ইত্তেফাক