ঝুট কাপড়ে ভাগ্যবদল
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম শাঁওইল। বড় বড় পোশাক কারখানার অবশিষ্ট কাপড় বা ফেলে দেওয়া ঝুট কাপড়ে ভর করে গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে একটি ক্ষুদ্র শিল্প, যা এলাকায় আদমদীঘির ‘ঝুটপল্লী’ হিসেবে পরিচিত। এখানকার শ্রমিককরা ঝুট থেকে সুতা বের করে নতুন কাপড় বুনছে। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে উপজেলার ৭৫টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবার। শিল্পটি এলাকার বহু মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণে যেমন ভূমিকা রাখছে তেমনি সৃষ্টি করছে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও তাঁতিদের চেষ্টায় ধীরে ধীরে শিল্পটির প্রসার হলেও এর থেকে বেশির ভাগ সুফল নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। বাজার সৃষ্টি আর পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ঢাকার ব্যবসায়ীরা কম দামে কাপড় কিনে মুনাফা লুটছে। ব্যবসায়ীদের ঋণপ্রাপ্তিতেও রয়েছে নানা জটিলতা।
শাঁওইল বাজারে ঝুটপল্লীতে বছরজুড়ে কর্মযজ্ঞ চললেও বিক্রির আসর শীতকাল। বাজারটিতে এক হাজার ২০০ দোকানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া। রং ভেদে কেউ ঝুট বাছাই করে, কেউ বাছাই থেকে সুতা নাটাই করে আর কেউ চরকা ঘুরিয়ে সুতা একত্র করে। প্রতিটি দোকানেই তিনজন করে তিন হাজার ৬০০ নারী শ্রমিক কাজ করছে। আরো ছয় হাজার পুরুষ শ্রমিক মিলে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান সেখানে। এই ঝুটপল্লীর মানুষকে ঋণ সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশন (এসএমই)। সরকারি ও অন্যান্য ব্যাংকে জামানত দিয়ে ১৩-১৪ শতাংশ হারে ঋণ পায় ব্যবসায়ীরা। তবে এসএমই একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো জামানত ছাড়া ৯ শতাংশ হারে ঋণ দিচ্ছে। স্বল্প সুদের ঋণে অন্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা করছে ব্যবসায়ীরা।
এসএমই ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, শাঁওইল হ্যান্ডলুম এসএমই ক্লাস্টারের উন্নয়নে সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করছে। ক্লাস্টারটির উন্নয়নে বর্তমানে ফাউন্ডেশন বিভিন্ন মেয়াদি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগও নিয়েছে। এ ছাড়া উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যে উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে বহুমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান, যেমন—পণ্যের ডিজাইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, ব্যবসা পরিচালনা, ট্যাক্স, ভ্যাট, হিসাবরক্ষণ, প্রজেক্ট প্রপোজাল তৈরি বিষয়ক প্রশিক্ষণ, উৎপাদন পদ্ধতি আধুনিকায়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, সমিতির কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। উদ্যোক্তাদের পণ্যের ওয়েবসাইট প্রস্তুতকরণ ও পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণেও কাজ করছে তারা।
শাঁওইল ছাড়াও দত্তবাড়িয়া, ফেনিঞ্জা, মঙ্গরপুর, ধামাইল, গোড়াদহ, কেশটা, মুরাদপুর, চাতিয়ান, ছাতনী, লইকুরসহ আশপাশের অর্ধশতাধিক গ্রামেও একই চিত্র বলে জানায় স্থানীয়রা। এসব গ্রামের প্রান্তিক ও খেটে খাওয়া মানুষ শাঁওইল বাজারের ঝুট থেকে সুতা তৈরিতে প্রতি কেজিতে পায় ২০ টাকা। পরিবারের সদস্যরা মিলে এ কাজ করে। চুক্তিভিত্তিক সুতা ছাড়ানো ব্যতীত একজন নারী শ্রমিক দিনে ১২০-১৫০ টাকা পায় আর পুরুষ পায় ২২০-২৫০ টাকা। এই কাজের মাধ্যমে মাসে আয় হচ্ছে পাঁচ-সাত হাজার টাকা। লোকগুলোর কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। কোনো পরিবারের মাসে আয় ১৭-২০ হাজার টাকা। শীত মৌসুমে ৫০০ কোটি টাকার বেশি কাপড় কেনাবেচা হয় এখানে। এই গ্রামে কোনো বেকার নেই কিংবা কোনো ভিক্ষুকও নেই বলে জানায় স্থানীয়রা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শাঁওইল বাজারে নারী-পুরুষ একত্রে বসে কাজ করছে। পুরনো ঝুট থেকে ভালো কাপড় বাছাই করে সেগুলো থেকে সুতা তৈরির প্রক্রিয়া করছে। কেউ সুতা নাটাই করছে। কেউ নাটাই একত্র করে পাঠাচ্ছে ডায়িং করতে। গ্রামজুড়েই রয়েছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক তাঁত। এসব তাঁতে সারা বছরই চলে বড় চাদর, বড় কম্বল, বিছানা চাদর, লেডিস চাদর, কম্বল, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালেসহ নানা ধরনের শীতবস্ত্র তৈরির কাজ।
ঝুট প্রক্রিয়াকরণ : ব্যবসায়ীরা পোশাক কারখানা ঘুরে প্রথমে ঝুট সংগ্রহ করে। দাম পড়ে প্রতি কেজি ১৫ থেকে ১০০ টাকা। ১০০ কেজি ঝুটে ৯৫ কেজি সুতা উৎপন্ন হয়। আর বাকি পাঁচ কেজি থেকে হয় দড়ি ও তুলা। অর্থাৎ ঝুটের কোনো অংশই বাদ দেয় না ক্ষুদ্র তাঁতিরা। প্রথমে ঝুট থেকে রংভেদে কাপড় বাছাই করা হয়। বাছাইপ্রক্রিয়া শেষে প্রতি কেজি ২০ টাকার বিনিময়ে সুতা ছাড়ানোর জন্য কাজ নিয়ে যায় স্থানীয়রা। সুতা ছাড়িয়ে নাটাই করে ফিরিয়ে দিতে হয় মালিককে। মালিক সুতা পাওয়ার পর ঢাকা কিংবা ফেনীর ডায়িং ফ্যাক্টরিতে সুতা ডায়িং করে। আর এই সুতা কুষ্টিয়া, কুমারখালী, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও নরসিংদীর বড় তাঁতিদের কাছে দেওয়া হয়। সেখানে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় বানানো হয়। আবার স্থানীয় পর্যায়ে ছোট ছোট তাঁতিরাও কাপড় বোনে। সেই কাপড় ক্রেতারা নিয়ে যায়।
জানা যায়, খুব ক্ষুদ্র পরিসরে ১৯৮৫ সালে ঝুট থেকে কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুরুর দিকে কয়েকজন ব্যবসায়ী শরীয়তপুর ও খুলনা অঞ্চল থেকে অব্যবহৃত ও ফেলে দেওয়া সোয়েটার সংগ্রহ করে কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন। সোয়েটারের সুতা বের করে বোনা হয় নতুন কাপড়। সেই থেকে যাত্রা শুরু। এরপর ক্রমেই এর কর্মযজ্ঞ বেড়েছে। ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ঝুট সংগ্রহ করেন তাঁরা। প্রতি রবিবার ও বুধবার শাঁওইল বাজারে বসে কম্বল-চাদরসহ বিভিন্ন ধরনের শীতবস্ত্রের হাট। বিক্রি হয় কোটি কোটি টাকার পণ্য। ঢাকার বড় ব্যবসায়ীরা এই কাপড় কিনে নিয়ে যান।
ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে ঝুট দিয়ে মিরপুরে অনেক খালি জায়গা ভরাট হতো। সেই খোঁজ পাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা ঢাকা থেকে ঝুট সংগ্রহ করেন। পাঁচ থেকে সাতটি দোকান দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন এক হাজার ২০০ দোকান। পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ভাগ্য বদলেছে অনেকের। ব্যবসা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ঋণ জটিলতায় ভুগছেন ব্যবসায়ীরা। সহজে ঋণ পান না। দুই-একটি ব্যাংক কম হারে ঋণ সহায়তা দিলেও অন্যগুলোতে সুদের হার অনেক বেশি।
স্থানীয় দোকানদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঝুট পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে সম্ভাবনার সৃষ্টি হলেও নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত এই ব্যবসা। নেই ডায়িং মেশিন। ঢাকা কিংবা ফেনী গিয়ে ডায়িং করতে হয়। অবকাঠামোর অভাবে খোলা আকাশের নিচে বসে প্রক্রিয়াকরণ ও পণ্য বিক্রি করতে হয়। ব্যবসা সম্প্রসারণে ঋণ পাওয়া যায় না। অনেক ব্যাংকও ঋণ দিচ্ছে না। আবার কোনো ব্যাংক দিলেও সুদের হার চড়া। শাঁওইল ঝুটপল্লীকে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ঘোষণা দিয়ে সরকারের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
বারাকা ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘এই ব্যবসাটিকে আঁকড়ে ধরেই সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে শাঁওইল গ্রামের মানুষ। নারী-পুরুষ মিলে এই গ্রামে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। জমিতে দিনমজুরের কাজ ছেড়ে অনেকে এই কাজে যোগ দিচ্ছে। বছরজুড়ে পণ্য উৎপাদন করা হয় আর শীতকালে বিক্রি হয়। এই অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে এই কম্বলপল্লী বা ঝুটপল্লীকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান প্রয়োজন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বড় ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হবে এই গ্রাম। ’
রনি মিয়া নামের এক শ্রমিক বলেন, এই ব্যবসা গ্রামকে পাল্টে দিয়েছে। কোনো ঘরেই খাবারের অভাব নেই। প্রক্রিয়াকরণ করে এক কেজি সুতা পেতে ৬০-৭০ টাকা খরচ হয়। সেই সুতা তাঁতে বুনে একটি কাপড় হয়। সেটি ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি করা হয়। সবাই এই কাজে ঝুঁকছে। কেউ বসে থাকে না। সুযোগ পেলেই কাজে লেগে যায়।
সত্তরোর্ধ্ব নিজামুদ্দিন বলেন, এই ব্যবসায় অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসায়ীর সংখ্যাও বেড়েছে। সচ্ছলতা এসেছে এই গ্রামে। তবে নব্বইয়ের দশকে কেনা-বেচার পরিবেশ যেমন ছিল তেমনই আছে। খোলা আকাশের নিচে বাজার বসে। সেখানেই বিক্রি করতে হয়। সরকারের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে এই শিল্পকে এগিয়ে নিলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখবে।
আবু সাঈদ এন্টারপ্রাইজের মালিক ও তাঁতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘খুব ক্ষুদ্র পরিসরে কাপড় তৈরি শুরু করি। ক্রমেই এটি বাড়িয়েছি। ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সহজে পাওয়া যায় না। তবে এসএমই ফাউন্ডেশন খুব কম সুদে ঋণ দিয়েছে, যা খুবই উপকারী। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে ঋণ সহায়তা খুব জরুরি। ’

 
	                
	                	
	            
 
	                       			                       	 
	                       			                       	 
	                       			                       	 
	                       			                       	