দুই তরুণীর ‘যেতে চাও ডটকম’
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
আমাদের আশেপাশে প্রতিদিনই অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন ইভেন্ট যার মধ্যে আছে সেমিনার, কনসার্ট, কর্মশালা কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এসব ইভেন্টের খোঁজ রাখা সম্ভব হয় না। আর এগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে নিয়মিত সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখতে হয় যা সবসময় সম্ভব হয় না। যদিও বর্তমান সময়ে ফেসবুক কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন ইভেন্টের খোঁজ নেওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কেমন হতো যদি সব ইভেন্টের খবর এক জায়গায় পাওয়া যেত? এমনই ধারণা থেকে ২০১৫ সালের আগস্টে চালু হয়েছে ‘যেতেচাও ডট কম’। ওয়েবসাইটটিতে যে শুধু ইভেন্টের খবরই পাওয়া যাবে, তা নয়। কেনা যাবে বিভিন্ন ইভেন্টের টিকেটও। ওয়েবসাইটটির দুই উদ্যোক্তা মেহনাজ তাবাসসুম এবং রীম সামসুদ্দোহা।
উদ্যোগটি চালুর পেছনের গল্প শোনালেন মেহনাজ। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময় সেখানে আমরা বিভিন্ন কনসার্টে যেতাম। আর এসব কনসার্ট বা অন্যান্য ইভেন্টের টিকেট সহজেই টিকেট মাস্টার থেকে কিনে নিতাম। তখনই মাথায় এলো যে আমাদের দেশে এমন কিছু করা যেতে পারে যার মাধ্যমে মানুষ সহজেই ঘরে বসে কোনো কনসার্ট, ম্যুভি কিংবা অন্য কোনো ইভেন্টের টিকেট কিনতে পারবে।’ তিনি আরও জানান, ইভেন্টব্রাইট নামক একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট রয়েছে যা বাংলাদেশেও ব্যবহার করা যায়। তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য এমন কোনো ওয়েবসাইট নেই। আর এই ধারণা থেকেও গত বছরের আগস্টে দুই বন্ধু মিলে চালু করেন যেতেচাও ডট কম। অপর সহ-প্রতিষ্ঠাতা রীম বলেন, ‘বর্তমানে আমরা শুধু ঢাকার বিভিন্ন ইভেন্টের খোঁজই দিচ্ছি। শুরুতে আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ইভেন্টের খোঁজ নিয়ে আমাদের ওয়েবসাইটে দিয়েছি।’ তবে কোনো ইভেন্টের বিস্তারিত তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল সেই ইভেন্টটি ওয়েবসাইটে যুক্ত করা হয় বলে জানান মেহনাজ তাবাসসুম। তিনি আরও জানান, প্রথমদিকে ওয়েবসাইটটিতে শুধু ইভেন্টের তথ্য দিলেও গত বছরের ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন ইভেন্টের টিকেট বিক্রির কাজও শুরু করেছেন তারা। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ইভেন্ট এবং টিকেটিং পার্টনার হিসেবেও কাজ করছে যেতেচাও ডট কম।
তবে শুরুর দিকটা তাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল বলে জানান দুই প্রতিষ্ঠাতা। মেহনাজ এ বিষয়ে বলেন, ‘আসলে যেকোনো উদ্যোগ শুরু করাই বেশ চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে উদ্যোগটি যদি হয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে ঘিরে। আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষ করে বিভিন্ন পার্টনার প্রতিষ্ঠানকে শুরুতে আমাদের উদ্যোগ সম্পর্কে বুঝাতে বেগ পেতে হয়েছিল। আমাদের শুরুতেই সবাইকে বুঝাতে হয়েছিল অনলাইনে টিকেট বিক্রি করলে কী লাভ হবে কিংবা কেন তাদের অনলাইনে টিকেট বিক্রি করা উচিত। এর কারণ হলো বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান কিন্তু তাদের ইভেন্টের টিকেট নামকরা সুপারশপগুলোর মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে যেখানে বিক্রির পরিমাণও বেশ ভালো থাকে। এটি আমাদের জন্য বেশ বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনও মানুষ অনলাইনের চেয়ে অফলাইনকেই প্রাধ্যান্য দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তেমনই হয়েছে। অনেক সময় আবার দেখা যায় যাদের অনলাইন সম্পর্কে ধারণা কম, তারা সহজে অনলাইনের কোনো কিছুকে বিশ্বাস করতে চায় না। এসব সমস্যাকে অতিক্রম করেই আমাদের সামনে এগুতে হচ্ছে। আমরা মানুষের মাঝে প্রচলিত ধারণাগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এর ফলাফলও কিন্তু পাচ্ছি।’
ওয়েবসাইটটির মূল ব্যবহারকারী কারা, এমন প্রশ্নের জবাবে মেহনাজ জানান, ‘মূলত ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীরাই আমাদের এই ওয়েবসাইটটি বেশি ব্যবহার করে থাকে। এর কারণ হলো আমাদের মূল ব্যবহারকারীরা তরুণ। আমরা দেখেছি যে তারাই ঘুরেফিরে আমাদের ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করে, অর্থাৎ তারাই রিটার্নিং ইউজার। তাদের অধিকাংশই হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিংবা সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত বিভিন্ন সেমিনার কিংবা ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করে। আমাদের ওয়েবসাইটেও কিন্তু তারা এসব সেমিনার, ওয়ার্কশপের খোঁজ করে থাকে। তাদের কথা মাথায় রেখে আমরা নিয়মিত এ ধরনের ইভেন্টের তথ্য যুক্ত করি।’ এ বিষয়ে রীম বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের একটি ইভেন্ট হচ্ছে যা বাইরের অনেকেই জানে না। আমরা চাই ইভেন্টটি সম্পর্কে সবাই জানুক। আর তাই এ ধরনের ইভেন্টগুলো আমরা নিয়মিতই ওয়েবসাইটে যুক্ত করি।’
শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ ভালো সাড়া পেয়েছেন তারা। ‘আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকায় অনেকেই আছেন যারা নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে আগ্রহী। কিন্তু পেশা সংক্রান্ত ব্যস্ততার কারণে বিভিন্ন আয়োজন সম্পর্কে তাদের তেমন খোঁজ নেওয়ার সুযোগ থাকে না। তাদের জন্য প্রতি সপ্তাহের শেষে আমরা একটি নিউজলেটার পাঠিয়ে দিই যেখানে পরবর্তী এক সপ্তাহের সকল ইভেন্টের বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকে। অনেকেই এই নিউজলেটারের জন্য আমাদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এর মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে গ্রাহকদের আস্থা তৈরি করতে পারছি’ বলেন মেহনাজ। ইতোমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইভেন্টের টিকেটিং পার্টনার হিসেবে কাজ করেছে যেতেচাও ডট কম। এর পাশাপাশি সম্প্রতি ফারহান আখতার এবং অরিজিৎ সিংয়ের টিকেট পার্টনারও ছিল যেতেচাও ডট কম।
শুরুটা খুব বেশিদিন আগে না হলেও এরই মধ্যে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি গ্রিন অ্যান্ড রেড এবং ফিউচার স্টার্টআপের উদ্যোগে তৈরি করা ‘প্রোমোটিং বাংলাদেশ ২০১৬’ শীর্ষক সেরা ১০ স্টার্টআপের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে যেতে চাও। শুরুটা নিজেদের বিনিয়োগে শুরু হলেও বর্তমানে কয়েকটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানের সাথে বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা চলছে। মেহনাজ তাবাসসুম জানান, ‘এখন পর্যন্ত এখানে সম্পূর্ণ বিনিয়োগ আমাদের নিজেদেরই। তবে একটি স্টার্টআপ হিসেবে বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য আমরাও কাজ করছি। ইতোমধ্যেই কয়েকটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানের সাথে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’
আপাতত শুধু ঢাকার মধ্যে থাকলেও খুব শীঘ্রই দেশের আরও কয়েকটি বড় শহরে কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। এর পাশাপাশি এ বছরের শেষের দিকে চালু করা হবে স্মার্টফোন অ্যাপ যার মাধ্যমে হাতের আরও সহজেই সবাই বিভিন্ন ইভেন্টের খোঁজ পাবে। এ ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচারও চালু করার কথা জানান তারা। এটি হলো কোনো ইভেন্টে যেতে না পারলেও ওয়েবসাইট থেকে ইভেন্টটি সরাসরি উপভোগ করা যাবে।
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য মেহনাজ তাবাসসুম বলেন, ‘শুরুতে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে। কোনো কিছুতেই থেমে যাওয়া চলবে না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রথম বাধাটা আসে নিজের পরিবার থেকেই। আর তাই অনেক সময় উদ্যোক্তারা পুরো বিষয়টি কাছের মানুষজনের কাছে গোপন রাখে। তবে আমি মনে করি এটা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ সবাই যে শুধু নিরুৎসাহিত করবে, তা নয়। অনেকেই আছেন যারা উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে উৎসাহিত করে থাকেন। আর নতুন উদ্যোক্তার জন্য ফিডব্যাক নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটিতেই যদি একজন মেন্টর থাকেন, তাহলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার সেটি যাচাই করে নেওয়া সম্ভব হয়।’