অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে করণীয়

অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে করণীয়

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

আজ (২৪ সেপ্টেম্বর) ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আয়োজনে ‘অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের মেধা কাজে লাগানোর মহাপরিকল্পনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।


সূচনা বক্তব্য

মো. সবুর খান : আজকের গোলটেবিল বৈঠকে যারা এসেছেন তারা সবাই অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবী। আপনারা দীর্ঘদিন কোনো না কোনো পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। আপনাদের এই অবসরকালীন সময়কেও আমরা কাজে লাগাতে চাই। আপনাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান নিশ্চয় আমাদের চলার পথের সহায়ক হবে। তাই আমরা একটি অ্যাসোসিয়েশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। এই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে আমরা আপনাদের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করতে চাই।

আলোচনা

4ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম:  আপনারা ইতিমধ্যেই জেনেছেন আমরা আপনাদের নিয়ে একটি সংগঠন করতে চাই। এটা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম হবে যার মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবীরা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। আপনারা নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন। এতে করে আমরা সবাই উপকৃত হবো।

সরদার এ নাঈম: অবসরজীবন সত্যিই দুর্বিসহ। তখন সময় কাটতে চায় না। নানা ধরনের হতাশা, বিষণ্নতা এসে ভর করে। ফলে প্রবীণরা দ্রুত অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। প্রবীণদের যদি কাজের মধ্যে রাখা যায় তবে তারা সুস্থ্য থাকেন। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ, প্রবীণদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য।

আবুল হাসেম খান: বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশেও বাড়ছে। প্রবীণদের যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তবে তারাও মানবসম্পদে পরিণত হতে পারেন। এ জন্য এখন থেকেই ভাবতে হবে। আমি মনে করি প্রবীণদের কাজের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। তারা যে কাজ করে আনন্দ পান সেই কাজ করতে দেওয়া উচিত।

প্রফেসর ড. এস এম কেরামত আলী: আমি পুষ্টিবিজ্ঞানের শিক্ষক। পুষ্টি মানুষের একটি মানবাধিকার। কিন্তু আমাদের দেশে বয়ষ্ক মানুষরা যথাযথ পুষ্টিকর খাবার পান না। ফলে তারা নানা ধরনের রোগে ভোগেন। আমি মনে করি প্রবীণদের স্বাস্থের দিকে নজর দিতে হবে। এ জন্য এই সংগঠনে পুষ্টিবিদদেরও রাখতে হবে।

মেজর জেনারেল জীবন কানাই দাস (অব.) : অবসরে যাওয়া সব ধরনের পেশাজীবীদের এক প্ল্যাটফর্মে আনার এটিই সম্ভবত প্রথম উদ্যোগ। দেশে পেশাজীবীদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে অনেক সংগঠন আছে। যেমন ডাক্তারদের সংগঠন আছে, প্রকৌশলীদের আছে, ব্যবসায়ীদের আছে, কিন্তু সবার জন্য একটি সংগঠন নেই। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিনন্দন এ রকম একটি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।

বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আনিসুজ্জামান ভুঁইয়া (অব.): একজন ব্যাক্তির পক্ষে সব বিষয়ে অভিজ্ঞ হওয়া সম্ভব নয়। একেক জন একেক বিষয়ে অভিজ্ঞ। দেশ যদি এগিয়ে যেতে চায় তবে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। ড্যাফোডিল এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছে যাতে সব অভিজ্ঞতা একত্র করা যায়। ধন্যবাদ ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়।

5প্রফেসর ড. বজলুল হক খন্দকার: মানুষ তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ থাকতে চায়। একজন মানুষ যখন প্রবীণ হয়ে যান, পেশা থেকে অবসর নেন তখনও তিনি গুরুত্বপূর্ণ থাকতে চান। এটাই মানুষের স্বভাব। প্রবীণ পেশাজীবীদের গুরুত্ব দিয়ে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় একটি সংগঠন করতে চাইছে, এটা আশাব্যাঞ্জক খবর। তবে আমার পরামর্শ থাকবে পেশাজীবীদের গ্রুপ অনুসারে ভাগ করা।

নাসির উদ্দিন আহমেদ: কোনো সংগঠনই এমনি এমনি চলতে পারে না। এজন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। এই সংগঠনের আর্থিক সংস্থানের উৎস কী হবে সেটাও শুরু থেকে ভাবা উচিত। তাছাড়া সংগঠনকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগও শুরু থেকেই নেওয়া উচিত। কারণ পেশাজীবীরা শুধু ঢাকা শহরেই থাকেন না, ঢাকার বাইরেও থাকেন।

ড. উম্মে সালেমা বেগম: সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে সবাই অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন। আমি শুধু বলব, এই সংগঠনে যারা আসবেন তারা যেন তাদের বার্ধক্যকে উপভোগ করতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিটাই এমন যে, এখানে কেউ তার অবসর জীবন সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারেন না। আমি চাই এই সংস্কৃতির পরিবর্তন হোক।

প্রফেসর শাজাহান খান: দিনের পর দিন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে করতে একজন মানুষ কাজের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই অভ্যস্থতায় ছেদ পড়ে যখন সে অবসরে চলে যায়। ফলে তার জীবনে বিষণ্নতা এসে ভর করে। আমার একটাই পরামর্শ, সেটা হচ্ছে, প্রবীণদের কাজ দিতে হবে।

মাসুমা খান:  আমি ও আমার স্বামী মিলে দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে একটি প্রতিষ্ঠান চালাই। এটি অসহায় প্রবীণদের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র। এই পুনর্বাসন কেন্দ্র চালাতে গিয়ে দেখেছি, প্রবীণদের স্বাধীনতা দিলে, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিলে তারা ভালো থাকেন, সুস্থ্য থাকেন। তাই আমার খুব ভালো লাগছে যে, প্রবীণদের গুরুত্ব দিয়ে একটি সংগঠন করা হচ্ছে।

অ্যাড. এবিএম বায়েজিদ: আমি দেখেছি ইংল্যান্ডে এ ধরনের অনেক ক্লাব আছে। সেসব ক্লাবের যারা সদস্য সেই প্রবীণরা অসম্ভব অ্যানার্জেটিক। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর তারা। নানা ধরনের কাজ করছেন। হেসে খেলে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ আমাদের দেশের প্রবীণরা নানা ধরনের অসুখে ভোগেন। আমার বিশ্বাস প্রবীণদের কাজ দিলে তারাও কর্মব্যস্ত থাকবেন। দেশ ও জাতিকে তারা অনেক কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল: সাভারে আমার একটি প্রতিষ্ঠান আছে। প্রবীণ কল্যাণ সংঘ। ২৯ বছর আগে এটি আমি প্রতিষ্ঠা করি। এখানে একেবারে অসহায় প্রবীণ যাদের দেখার কেউ নেই তাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু ড্যাফোডিল বিশ্বিবদ্যালয় প্রবীণদের নিয়ে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেটি একটি অভিনব উদ্যোগ। পেশাজীবী অভিজ্ঞ প্রবীণদের একত্র করার উদ্যোগ। এ উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। কারণ আমি প্রবীণদের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি।

6কাজী আকরাম উদ্দীন আহমদ: কিছু কিছু কাজ আছে মানুষকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এটি তেমনই একটি অনুপ্রেরণামূলক কাজ। আমার বিশ্বাস এ উদ্যোগ সফল হবে। আর এ উদ্যোগ সফল হলে আমাদেরকে আর বিদেশ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডেকে এনে চাকরি দিতে হবে না। এই প্ল্যাটফর্মেই অনেক বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাবে। আপনারা জানেন, আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে চীন, জাপান, শ্রীলংকার বিশেষজ্ঞ কাজ করেন। তারা প্রতিমাসে প্রচুর টাকা নিজ দেশে নিয়ে যান। আমরা নিজেরাই যদি বিশেষজ্ঞ পেয়ে যাই তাহলে তাদেরকে আর ডেকে আনতে হবে না। ফলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়কে আবারও ধন্যবাদ এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।

কাজী রিয়াজুল হক: অবসরে যাওয়া পেশাজীবীদের নিয়ে সংগঠনের ধারনা বাংলাদেশে নতুন। এই কনসেপ্ট সফল হলে সর্বমহলে প্রশংসিত হবে। আমি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই এরকম একটি সময়পোযোগী উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। সময় উপযোগী এ জন্য বলছি যে, আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। বুঝতেই পারছেন, এটি হবে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী।  এই বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে ব্যাবহারের পরিকল্পনা এখনই না করলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে। আশার কথা, সময় থাকতেই ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সমাপনী বক্তব্য

ইউসুফ মাহবুব ইসলাম: ধন্যবাদ সবাইকে, আপনাদের মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য। আপনাদের পরামর্শের আলোকে সংগঠনটির চূড়ান্ত রূপরেখা দাঁড় করানো হবে। আশা করি আগামী দিনে এই সংগঠনের পাশে আপনাদের সবাইকে পাব।

আলোচনায় সুপারিশ

* সংগঠনটির একটি লোকাল মডেল তৈরি করতে হবে। এটি পরিচালিত হবে কেন্দ্র থেকে।

* সকল অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের তথ্য নিয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে।

* পেশা ও বিশেষজ্ঞদের কাজের ক্ষেত্র ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ করতে হবে।

* সংগঠনটির ইকোনোমিক মডেল থাকতে হবে।

* প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকতে হবে।

* কাউন্সেলিং অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নামে বিভাগ রাখা যেতে পারে।

* ডিমান্ড ফর এক্সপার্টিজ নামে ক্যাটাগরি রাখতে হবে যাতে চাহিদা অনুযায়ী অন্য প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ সরবরাহ করা যায়।

* নবীনদের অংশ গ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে।

যারা অংশ নিলেন:

2কাজী রিয়াজুল হক: চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

কাজী আকরাম উদ্দীন আহমেদ: চেয়ারম্যান, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক

মো. সবুর খান: চেয়ারম্যান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

অধ্যাপক ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম: উপাচার্য, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

খতিব জাহিদ মুকুল: চেয়ারম্যান, গিভেন্সি গ্রুপ

বজলুল হক খন্দকার: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. এসএম কেরামত আলী: শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মির্জা বাকের (অব.): শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

মো. হাসান আলী: সভাপতি, এইজিং সাপোর্ট ফোরাম

বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আনিসুজ্জামান ভুঁইয়া (অব.): শিক্ষক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল (বিইউপি)

মেজর জেনারেল জীবন কানাই দাস (অব.): কান্ট্রি ডিরেক্টর, স্যার ইউলিয়াম বেভারেজ ফাউন্ডেশন

মাসুমা খাতুন লিপা: পরিচালক, গিভেন্সি গ্রুপ

ডা. সরদার এ নাঈম: চিকিৎসক, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল

অনুলিখন: মারুফ ইসলামfavicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment