অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অবিশ্বাস্য গল্প
- রনি আহমেদ
জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং আভিজাত্যে সমস্ত পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেওয়া এক সময়ের শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ স্পেনের ইসলামী সাম্রাজ্য যখন বিলুপ্তির প্রহর গুনছিল, সমস্ত জৌলুশ হারিয়ে বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফত যখন বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছিল, আশার আলো হয়ে দেখা দেওয়া সেলজুক সাম্রাজ্যও তখন তার শক্তি এবং সমৃদ্ধি হারিয়ে শুধু অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। অন্যদিকে মোঙ্গল শক্তি প্রতিটি মুসলিম জনপদে খুন, লুন্ঠন আর হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতায় মত্ত। সমস্ত দুনিয়া যখন ইসলামের শেষ দেখছিল, ঠিক তখনই মুসলিমদের জন্যে আশার আলো হয়ে আসেন যাযাবর এক মুসলিম বীর। যার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহের আরেকটি নবজাগরণের গল্প রচিত হয়। তিনি হলেন আরতুগ্রুল গাজী। বলা হয়ে থাকে যে, আরতুগ্রুল গাজী অটোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে যান।
আরতুগ্রুল গাজী আনুমানিক ১১৯১-১১৯৮ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে আহলাত শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল সুলেইমান শাহ। সুলেইমান শাহ ছিলেন অঘুজ তুর্কিদের কায়ী গোত্রের নেতা। কায়ী গোত্র ছিলো একটি অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত যাযাবর জাতি। তুর্কি পণ্ডিত মাহমুদ আল কাশগারি কায়ী শব্দের অর্থ বলেন, সম্পর্কের দ্বারা যার ক্ষমতা আছে। তার পিতা সুলেইমান শাহের সেনাবাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন আরতুগ্রুল। সুলেইমান শাহ তার বসতিকে নিয়ে খোরাসান নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। হিজরির সপ্তম শতাব্দের একেবারে শুরুতে মঙ্গোল বাহিনী যখন খোরাসান আক্রমণ শুরু করে তখন সুলেইমান শাহ তার বসতি নিয়ে তুর্কমেনিস্তানের মার্ভ অঞ্চলে চলে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। সুলেইমান শাহের নেতৃত্বের যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে অন্যান্য তুর্কিরাও তার কাছে এসে একত্রিত হতে থাকে। এভাবে তার দল ভারী হতে থাকে। আর এখানেই, তিনি সঠিকভাবে তার শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকেন। এছাড়াও তার গোত্র যাতে কোনো ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেইদিকেও সর্তক দৃষ্টি রাখেন।
চেঙ্গিস খান তার মৃত্যুর তিন বছর আগে অর্থাৎ ৬২১ হিজরিতে (১২২৪ খ্রী.) সেলজুক সাম্রাজ্য আক্রমণের জন্য এক বিশাল বড় দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনী প্রেরণ করেন। সেই সময় সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী কুনিয়ার সিংহাসনে ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ সেলজুকী। এক সময়ের মহা শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ সেলজুক সাম্রাজ্য তখন অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তখন সুলেইমান শাহের কাছে এই খবর পৌঁছাল যে মোঙ্গল বাহিনী আলাউদ্দিন কায়কোবাদের উপর আক্রমণ করেছে। এটা শোনার সাথে সাথেই তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন। কারণ কুনিয়ার সুলতান ছিলেন একজন মুসলমান, অন্যদিকে মোঙ্গলরা ছিল কাফের। মোঙ্গলরা ইতোমধ্যেই তাদের ধ্বংসযজ্ঞ দ্বারা মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস করে ফেলছিল। সুলেইমান শাহ আলাউদ্দিন কায়কোবাদকে সাহায্য করা এবং এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাকে শাহাদাত বরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুযোগ বলে ঘোষণা দেন। নিজ গোত্রকে যুদ্ধে যাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে বলেন।
তখন আরতুগ্রুল সেনাবাহিনীর দলপতি হয়ে ৪৪৪ জন সৈন্য নিয়ে সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। মোঙ্গল বাহিনী ছিলো অত্যন্ত দুরন্ত এবং দুর্ধর্ষ। ফলে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই সেলজুক বাহিনীকে কোনঠাসা করে ফেলে। সেলজুল বাহিনী যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন সেখানে আরতুগ্রুল এবং তার সৈন্য বাহিনি গিয়ে উপস্থিত হয়। আরতুগ্রুল এবং তার সৈন্যবাহিনি যখন যুদ্ধের স্থানে গিয়ে পৌঁছেছিল তখন সেখানে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। কারণ আরতুগ্রুল জানতেন না কোনটা কোন পক্ষ। তিনি দুটি বাহিনীকে পরস্পরের যুদ্ধরত অবস্থায় দেখতে পান। কিন্তু তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মনস্থির করেন যে তিনি দুর্বল পক্ষকে সাহায্য করবেন। আরতুগ্রুল তার ৪৪৪ জন সৈন্য নিয়ে দুর্বল পক্ষের হয়ে সবল পক্ষের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আরতুগ্রুল আকস্মিকভাবে অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং দুঃসাহসিকতার সহিত মোঙ্গল বাহিনীর উপর আক্রমণ চালান। আরতুগ্রুল এবং তার সৈন্য বাহিনির বীরত্বে মোঙ্গলরা বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। যার ফলে তারা তাদের অসংখ্য লাশ ফেলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। আলাউদ্দিন কায়কোবাদ কিছুক্ষণ আগেই পরাজয়কে যেখানে অবধারিত বলে গ্রহণ করেছিলেন সেখানে পরাজয়ের বিপরীতে বিজয় অর্জিত হওয়ায় আরতুগ্রুলকে রহমতের ফেরেশতা বলে বুকে টেনে নেয়।
এই বিশাল সাহায্যের পুরস্কার স্বরূপ আলাউদ্দিন কায়কোবাদ আরতুগ্রুলকে কারাকা দাগের শহর (বর্তমান আংকারা) উপহার দেন। অন্যদিকে সুলেইমান শাহকে তার সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান করেন। সেলজুক সাম্রাজ্য শুরুর দিকে অনেক বড় ছিল। কিন্তু একদিকে বাইজেন্টাইন আর অন্যদিকে মোঙ্গল বাহিনীর চাপে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা রাজ্যে পরিণত হয়। যার অস্তিত্ব যেকোনো সময় বিলীন হয়ে যেতো। আরতুগ্রুলের সাহসিকতা এবং বীরুত্ব দেখে আলাউদ্দিন কায়কোবাদ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে তাকে আংকারা শহর উপহার দেন। যার অবস্থান ছিল একবারে রোমান সীমান্তে যেন আরতুগ্রুলের মাধ্যমে রোমানদের হামলাকে রুখে দেওয়া যায়।
এর কিছুদিন পরেই আরতুগ্রুল রোমানদের সাথে এক যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেন। যার ফলে সে রোমানদের বেশ কিছু জায়গা জয় করে নেয়। আরতুগ্রুল এরপর মনোনিবেশ করেন রোমানদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে পরিচিত হাংলি বাজারে। মূলত হাংলি বাজার থেকেই সীমান্তবর্তী এই এলাকায় সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এই বাজারে কোনো ন্যায়বিচার ছিলো না। জুলুম এবং অত্যাচারে পরিপূর্ণ ছিলো এই বাজার। আরতুগ্রুল এই বাজার জয় করার লক্ষ্যে তার সৈন্য বাহিনি নিয়ে আক্রমণ চালায়। আরতুগ্রুলের সৈন্য বাহিনি এবং হাংলি বাজারে অবস্থিত রোমান সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে রোমান সৈন্যদের পরাজিত করে এই বাজার জয় করে নেন তিনি। বাজার থেকে সকল সুদ, অবিচার এবং অন্যায় দূর করেন। বাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যায়বিচার এবং সব ধর্মের মানুষের জন্যে বাজারটি উন্মুক্ত করে দেন।
পরবর্তীতে আরতুগ্রুল কারাযাহিসার দুর্গ জয় করার দিকে মনোযোগ দেন। কারাযাহিসার দুর্গ ছিলো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ। কারণ এই দুর্গটি ছিলো সীমান্তবর্তী আর এখান থেকেই হাংলি বাজার সহ সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যকম নিয়ন্ত্রণ হতো। কারাযাহিসার দুর্গের গভর্নর এটা আগে থেকেই বুঝতে পারেন। যার ফলে দুর্গের নিরাপত্তা আরো বেশি জোরদার করেন এবং আরতুগ্রুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে অনেক চেষ্টার পরে আরতুগ্রুল এই দুর্গ জয় করেন এবং যার খ্যাতি সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই দুর্গ জয়ের ফলে অনেক বিচ্ছিন্ন তুর্কি গোত্র আরতুগ্রুলের সাথে একত্রিত হয়। যাতে আরতুগ্রুল আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে পড়ে। এই দুর্গ থেকেই আরতুগ্রুল তার সমস্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত করতে থাকেন। দুর্গকে বিশাল একটা ব্যবসায়ীক ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলেন। যেখান থেকে গ্রিসসহ অন্যান্য জায়গার ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে আসত। এই দুর্গ জয়ের পর তিনি এখানে একটা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
সময়ের সাথে সাথে আরতুগ্রুল আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেন। এরপর তিনি বিলেচিক দুর্গ জয় করেন এবং এখানেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আরতুগ্রুল সুগুত জয় করেন। আরতুগ্রুল অনেক বারের চেষ্টার ফলে সুগুত জয় করেন। সুগুত জয় করার সাথে সাথেই তিনি এখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। একইসাথে একটা মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বিশাল বড় একটা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম হয় সুগুত বাজার। সবচেয়ে বড় কথা তিনি এখানেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। কুরআনকে তিনি তার সংবিধান বানান। আরতুগ্রুলের একের পর এক জয়ের ফলে রোমানরা তাদের দুর্গ এবং জায়গা হারাতে থাকে। তাদের অধিপত্যে সীমান্তবর্তী এই এলাকায় লোপ পেতে থাকে। অবশেষে ১২৮৭ সালে ইসলামের এই বীরযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার পুত্র উসমানের বয়স ছিল ৩০ বছর। আরতুগ্রুলের মৃত্যুর পর তার পুত্র উসমান খান তার স্থলাভিষিক্ত হন। উসমান খান কায়ী গোত্রের প্রধান নেতা হওয়ার পর তার বাবার জয় করা সুগুত শহরকে রাজধানী ঘোষণা দেন এবং এখান থেকেই তার শাসনামল পরিচালিত করতে থাকেন। পরবর্তীতে একের পর এক বিজয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অটোমান সাম্রাজ্য বা উসমানীয় খিলাফত। অটোমান সাম্রাজ্য প্রথম উসমান প্রতিষ্ঠা করলেও এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি স্থাপন করেন যান তার পিতা আরতুগ্রুল গাজী।