যাত্রাপালা কি হারিয়েই গেল?
- রনি আহমেদ
বাংলাদেশে যাত্রা পালার প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকেই। বাংলার পল্লী অঞ্চলের মানুষের চিত্তবিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল যাত্রাপালাই। যাত্রা সমাজের দর্পন স্বরূপ, এটা একটা শিল্প। তবে এই যাত্রা শিল্প আজ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
যাত্রাপালার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। জানা যায়, শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুণ্ড্র, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখণ্ডে যাত্রাপালার অভিনয়ের প্রচলন ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উৎসবে কিংবা পালা করার উদ্দেশ্যে মানুষ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতেন আর এই যাওয়াকে যাত্রা বলে। সেই থেকেই এই শিল্পের নাম যাত্রা শিল্প। প্রথম দিকে গান নির্ভর ছিল যাত্রাপালা, যেমন-কৃষ্ণলীলা, রাধার মান ভঞ্জন, কংশবধ, সিতার বনবাস, লবকুশ ইত্যাদি। পরবর্তীতে কাব্যনির্ভর হয়ে যায়। যেমন মেঘনাথ বধ এবং শেষের দিকে এসে যাত্রাপালা সংলাপ নির্ভর হয়ে যায়।
শহরে সিনেমা হল থাকলেও গ্রামে সেসবের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি আগে টেলিভিশন, মোবাইল, সিডি ও ক্যাসেটের প্রচলনও ছিল না। গ্রামের মানুষের চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই যাত্রাই গ্রামের মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল। গ্রামের পুরুষ-মহিলা, ছেলে-মেয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে দল বেঁধে যাত্রা দেখতে যেতেন। এমনকি মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটেও তারা যাত্রাপালা দেখতে যেতেন। সেই সময় যাত্রার সংলাপ মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হতো। কখনো ভক্তি, কখনো ভালোবাসা, কখনো দেশপ্রেম তাদেরকে কাঁদিয়েছে এবং হাসিয়েছে।
কয়েকটি চৌকি পাশাপাশি সাজিয়ে যাত্রার মঞ্চ তৈরী করা হতো। উপরে দেওয়া হতো টিন বা ত্রিপল। মঞ্চে জ্বালানো থাকতো কয়েকটি হ্যাজাক লাইট। মঞ্চের এক দিকে বসতেন যন্ত্রীরা, অন্য দিকে বসতেন প্রমটার। প্রমটার সংলাপ পাঠ করতেন আস্তে আস্তে। মানুষ সমস্ত রাত জেগে যাত্রা পালা দেখতেন, আবার ভোরে নিজ নিজ কাজে চলে যেতেন। চলে যাবার সময় কেউ সংলাপ মুখস্ত বলতে বলতে যেতেন, কেউ যেতেন গান করতে করতে।
যাত্রাপালা ছিল কাহিনী-নির্ভর। সেই কাহিনী আবার বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, যেমন ঐতিহাসিক, সামাজিক, কাল্পনিক ও পৌরাণিক। পৌরাণিক যাত্রাগুলি আবার কখনো বিয়োগান্তক হতো না। সব সময়ই সেইগুলো হতো মিলনাত্মক। পূর্বে মেয়েদের চরিত্রে ছেলেদের অভিনয় করানো হলেও পরবর্তীতে মেয়েদের চরিত্রে মেয়েদের দিয়েই অভিনয় করানো শুরু হয়। যাত্রাপালায় গান এবং সংলাপ উচ্চ কণ্ঠে হতো, কারণ মঞ্চে মাইকের ব্যবস্থা থাকতো না। তাই সবার কানে শব্দ পৌঁছানোর জন্যে উচ্চ কন্ঠ ব্যবহার করা হতো। একজন ভালো মানের যাত্রা শিল্পী হতে হলে তার জন্য দরকার ছিলো ভাল কণ্ঠস্বরের। যাত্রা শুরুর আগ মুহুর্তে হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, বেহালা ও করতাল দ্বারা বিশেষ বাজনা ‘আখড়াই’ বাজানো হতো। এই বাজনা মানুষের মনকে অনেক বেশি দোলা দিত। এই বাজনা শোনা যেত অনেক দূর থেকে। দেশাত্মবোধক গান দিয়ে যাত্রা শুরু হতো। যাত্রা সাধারণত পাঁচ অংকের হয়ে থাকে (পাঁচ দৃশ্যে এক অংক)। যাত্রায় বিবেক নামে একটা চরিত্র থাকতো। যার কাজ ছিলো বিবেকের গান গাওয়া এবং এর মাধ্যমে মানুষের বিবেককে জাগ্রত করা।
যাত্রাপালার অভিনয়ের মধ্যে ছিল নায়কের অভিনয়, ভিলেনের অভিনয়, কৌতুক অভিনয়, বিবেক অভিনয় ও যন্ত্র শিল্পের অভিনয়। মানুষের মনে আজও সেসব যাত্রাপালা রয়ে গেছে। ধর্মীয় যাত্রাপালার মধ্যে রয়েছে নিমাই সন্ন্যাস, সীতার বনবাস, কংশবধ, রামায়ন, নৌকা বিলাস। এবং রূপকথার উপর ভিত্তি করে যেসব যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হতো তার মধ্যে অন্যতম রূপবান, বানেসা পরী অত্যাধিক জনপ্রিয় ছিলো।
আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে এবং যাত্রার নামে জুয়া, অশ্লীল নৃত্য পরিবেশনের প্রচলন শুরু হলে যাত্রা শিল্প ধীরে ধীরে বাঙালির লোকজ সংস্কৃতি হতে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। বাঙালির বিনোদনের একটি প্রধান অনুসঙ্গ ছিল যাত্রাপালা। এর মধ্য দিয়ে শুধু বিনোদন নয়, পুরাণ, ইতিহাস, লোকজ সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ চলতো। এখন সিনেমা, টেলিভিশনের কল্যাণে বিনোদনের রূপ পাল্টেছে। কিন্তু যাত্রার আবেদন গ্রামের মানুষের কাছে এখনও রয়েছে। রাতের পর রাত জেগে যাত্রার কাহিনি, অভিনয়, গানের মাধ্যমে লোকজ নীতিবোধ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে শিক্ষা নিতে চায় দর্শকরা। যাত্রা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ। যাত্রা শিল্পকে বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা।