বাংলাদেশের মধুর স্মৃতি
- লিয়ালু
আমার নাম লিয়ালু। বাড়ি চীনে। আমি চীনের হেনান প্রভিন্স এলাকার সিয়াস ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে পড়ছি। আমার একটি ইংরেজি নামও আছে—র্যাচেল ! আর যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, সেখানকার বন্ধুরা দিয়েছিল বাংলাদেশি নাম–‘মালা’! মজার ব্যাপার হচ্ছে চীনা ভাষাতেও ঠিক একই উচ্চারণের একটি শব্দ আছে যার অর্থ ‘ঝাল’।
যখন আমি হাইস্কুলে পড়ি, তখন আমাদের স্কুলে ভিক্টোরিয়া নামের একজন উইক্রেনের শিক্ষক ছিলেন। তিনি অনেকটা বন্ধুর মতো ছিলেন। তাঁর তত্বাবধানে ছয় মাসের মধ্যে আমার ইংরেজির ওপর বেশ দখল চলে আসে। তখন আমি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে শিখি। আমার ভেতর তখন প্রবলভাবে ইচ্ছা জন্মে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা লাভ করার।
এই ইচ্ছে পূর্ণতা পায় ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তখন আকস্মিকভাবে জানতে পারি, বাংলাদেশের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ‘শীতকালীন ক্যাম্প ২০১৮’ অনুষ্ঠিত হবে। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করি। কারণ তখন পর্যন্ত আমি ‘বাংলাদেশি বাঘ’ এই শব্দ ছাড়া আর কিছু জানি না। যাইহোক, অনলাইনে কিছু প্রবন্ধ আর ভ্রমণ অভিজ্ঞা পড়লাম যেটা বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাকে একটু ‘ভয় ধরানো’ ধারনা দিল। আমি তখন দ্বিধায় পড়ে গেলাম, ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করব কি করব না। শেষ পর্যন্ত আমি ক্যাম্পে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই এবং শতভাগ বৃত্তি নিয়ে উইন্টার ক্যাম্পে অংশ নিই।
আমাকে অবশ্য অনেকেই বলেছিল, এত নেচিবাচক তথ্য জানার পরও তুমি কেন বাংলাদেশে যেতে চাচ্ছ? আমি তাদেরকে শুধু পুরনো চীনা প্রবাদ স্মরণ করিয়ে দিয়েছি–‘চোখে দেখে বিশ্বাস করো’। আমি নিজের চোখে দেখে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই। প্রতিটি দেশেই ভালো-মন্দ মানুষ আছে। না জেনে কোনো ব্যাপারে সাধারণীকরণ করা উচিত নয়।
তারপর ২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় আমার অবিস্মরণীয় বাংলাদেশ ভ্রমণ। সিয়াস ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে আমরা ৩২ জন শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তার দল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উইন্টার ক্যাপে অংশ নিই। সেখানে আমরা ছিলাম ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত।
বিমানবন্দরে নেমেই দেখি আমাদের জন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্বেচ্ছাসেবী দল অনেক আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। সবচেয়ে অবাক হয়েছি তারা যখন চীনা ভাষায় ‘হুয়ানিং’ বলে আমাদেরকে স্বাগত জানালো!
বাংলাদেশের আবহাওয়া সম্পর্কে পূর্বধারনা ছিল এরকম যে সেখানে বেশ গরম, তাই শুধু টি শার্ট আর একটা পাতলা কোর্ট পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম সেখানে দিনের এবং রাতের আবহাওয়ার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান! প্রথম রাতে ডরমেটরিতে ফিরে দেখি আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরগুলো ঝকঝকে তকতকে করে রাখা হয়েছে। দেখেই মনটা ভালো হয়ে গিযেছিল। তার আগে সারাদিন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সবুজ ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়িয়েছি এবং ড্যাফোডিল চেয়ারম্যান মো. সবুর খান পরিচালিত পেশা, নেতৃত্ব ও দক্ষতা শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়েছি।
পরের কয়েকদিন একটানা অনন্দ করেছি আমরা। গলফ, বাস্টেক বল, ফুটবলসহ বিভিন্ন ধরনের খেলায় অংশ নিয়েছি আর বাংলাদেশের সুস্বাদু সব খাবার খেয়েছি। বিশেষ করে হাত দিয়ে খাবার খেতে পারা ছিল আমার জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা। প্রথম বারের মতো হাত দিয়ে খাবার খাওয়া মোটেও কোনো সহজ কাজ নয়। যাইহোক, ভাত ও মাছ ভাজা খেয়ে বেশ মজা পেয়েছি। দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটা হচ্ছে, জাতীয় জাদুঘর দর্শন। জাদুঘরে গিয়ে বাংলাদেশর সংস্কৃতির পরিপূর্ণ ইতিহাস জানতে পারি। জাদুঘরের পেছনেই একটি হস্তনির্মিত পণ্যের মার্কেট রযেছে। আমরা সেখান থেকে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের জন্য উপহার সামগ্রী কিনি।
ভ্রমণের পুরোটা সময় স্বেচ্ছাসেবক, গাইড, পুলিশ, গাড়ির ড্রাইভার–প্রত্যেকে এতোটা সহযোগিতাপরায়ন ও যত্নশীল ছিলেন যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। প্রথম যেদিন আমি ঢাকায় পৌঁছাই, সেদিনকার আবহাওয়া ও খাবারের সঙ্গে নিজেকে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল চীনে ফিরে যাই। কিন্তু এক সপ্তাহ পর ফিরে আসার সময় বাংলাদেশকে আর ছাড়তে ইচ্ছা করছিল না। বিদায়ের সময় আমরা এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম যে প্রত্যেকের চোখ অশ্রুতে ছলছল করে উঠেছিল।
এক সপ্তাহের উইন্টারক্যাম্পে আমরা নাচানাচি করেছি, রিকশায় ঘুরে বেড়িয়েছি, জঙ্গলের মধ্যে ফায়ারক্যাম্প করেছি। গাজিপুরের পুরনো বাড়িগুলো দেখার সময় মনে হচ্ছিল আমরা সভ্যতার রূপালি যুগে ফিরে গেছি। আমরা অনেকটা সময় বাস ভ্রমণ করেছি। এই ভ্রমণের সময় পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে, দুটি দেশের সংস্কৃতি ও শিক্ষা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা হয়েছে।
সর্বোপরি ঢাকাকে মনে হয়েছে ব্যস্ত আর জনাকীর্ণ একটা শহর কিন্তু প্রাকৃতিক। মিশিমা তার বই ‘দ্য বুক অব ইন্ডিয়া’তে বলেছেন, এমনকি বাংলাদেশের দারিদ্রও বর্ণিল। কথাটা অরেকবার মনে পড়ল যখন দেখলাম এখনকার ভঙ্গুর ছাতাগুলোও ফুলের তৈরি আর গরিব মানুষগুলোর পোশাকও রঙিন।
দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশ একটি চমৎকার সংস্কৃতিসমৃদ্ধ দেশ। পরিষ্কার নিলাকাশ আর সবুজ পাতার বৃক্ষ আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মেঘনা নদীতে নৌকাভ্রমণ আমাদের বাংলাদেশ অভিযাত্রাকে পুরিপূর্ণতা দান করেছে।
বাংলাদেশি বন্ধুদের ধন্যবাদ, আমাকে একটি ভিন্ন পৃথিবীর সন্ধান দেয়ার জন্য। একই সঙ্গে ড্যাফোডি ও সিয়াস কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের জন্য এরকম একটি অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। ভবিষ্যতে তোমাদের সঙ্গে আবারও মিলিত হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম, বাংলাদেশিরা বন্ধুরা! তোমাদের সবার জন্য শুভ কামনা।
লিয়ালু : ডিআইইউ উইন্টার ক্যাম্প ২০১৮-তে অংশগ্রহণকারী সিয়াস ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।