মাইশার অক্সফোর্ড ডায়েরি
- সৈয়দা মাইশা তাসনিম, শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার স্বপ্ন ছিল আমার দীর্ঘদিনের। কিন্তু কখনও ভাবিনি, একদিন আমার এই স্বপ্ন সফল হবে। অবশেষে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
আমার নাম সৈয়দা মাইশা তাসনিম। আমি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। আমার সঙ্গে অক্সফোর্ডে পড়তে এসেছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই শিক্ষার্থী। তারা হলেন ইংরেজি বিভাগের নিধি চাকমা ও সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের মো. আশিকুর রহমান। আমরা যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্টফোর্ড কলেজে ‘ইংরেজি ভাষা ও ব্রিটিশ সংস্কৃতি প্রকল্প’ নামের কোর্সের জন্য আবেদন করেছিলাম। তারপর মনোনীত হওয়ার পর ভিসা প্রক্রিয়াকরণের জন্য আমরা আদাজল খেয়ে লেগে পড়ি এবং যেদিন ভিসা হাতে পাই সেদিন মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন পূরণ হলো। যখন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পা রাখি, সেই মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার একদিন আগেই আমরা লন্ডনে পৌঁছাই। সেখানে শিক্ষার্থীদের দুইটি দল ছিল। একটি বাংলাদেশ থেকে আমরা তিনজন এবং আরেকটি জাপান থেকে আসা ২৫জন শিক্ষার্থীর দল। শার্লট জ্যাকন নামের একজন প্রতিনিধি আমাদেরকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। লন্ডন থেকে অক্সফোর্ডে যাত্রা ছিল অবিস্মরণীয় ও আনন্দঘন। চারপাশ ছিল বরফে ঢাকা আর আকাশ থেকে পড়ছিল বৃষ্টি। ডরমেটরিতে পৌঁছার পর আমাদের প্রথমেই নৈশভোজ করানো হয়। তারপর আমাদের সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য নিয়োজিত স্টিভেন জিগিং নামের একজন ব্যক্তি আমাদের প্রত্যেকের হাতে আলাদা আলাদা কক্ষের চাবি তুলে দেন। আমাদের ডরমেটরিতে বিলিয়ার্ড ও টেবিলি টেনিস খেলার জন্য একটি পিংপং রুমও ছিল।
পরদিন দেখলাম, সবকিছুই নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে। সকাল ৮-৯টা পর্যন্ত নাস্তা গ্রহণের সময়। ক্লাসের সময় ৯-৪টা পর্যন্ত। এরমধ্যে চা বিরতি ও মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি রয়েছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের খাবারের জন্য রয়েছে বিশাল ডাইনিং হল। সবাই একসঙ্গে বসে খাবার খেতে খেতে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা ছিল আমাদের জন্য এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
প্রথম দিনের ক্লাসে সব শিক্ষার্থীকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক গ্রুপকে নির্দেশনা দেন একজন আবাসিক পথপ্রদর্শক। সবকিছুই চলছিল রুটিনমাফিক, যেটা আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি। আমাদের শিক্ষক, আবাসিক পথপ্রদর্শক ও জাপানি শিক্ষার্থীরা–সবাই অসম্ভব বন্ধুত্বপরায়ন। আমরা ব্রিটিশ সংস্কৃতি ও জাপানি সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেককিছু শিখেছি।
দুদিন পর অক্সফোর্ডের পক্ষ থেকে আমাদেরকে ব্রিটিশ রীতিতে চা-চক্রের মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। এরকম চা-চক্রে ব্রিটিশরা যে ধরনের খাবার খান ও পান করেন সেসব ঐতিহ্যবাহী খাবার গ্রহণের অভিজ্ঞা হয় আমাদের। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের খাদ্যাভ্যাস আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
একটানা এক সপ্তাহ ক্লাস করার পর অমরা দুই দিনের ছুটি পাই। এক শনিবারে আমাদের আবাসিক পথপ্রদর্শক আমাদেরকে টেমস নদী, ব্রিটিশ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর, লন্ডন আই ইত্যাদি ঘুরে দেখাতে নিয়ে যান। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে ব্যস্ততম শহর লন্ডন। তবে ব্রিটিশ স্থাপত্যের ভবন, এর মানুষজন ও আবহাওয়া লন্ডনকে অপূর্ব সৌন্দর্য দান করেছে।
পরদিন সকালে আমি যখন ঘর থেকে বের হলাম তখন বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, তুষারপাত হচ্ছে। জীবনে প্রথমবারের মতো তুষারপাত দেখার দৃশ্য আমি কোনোদিনও ভুলব না। আমি আর নিধি নাস্তার কথা ভুলে তুষারপাত উপভোগ করতে লাগলাম। যেহেতু বাংলাদেশে এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ নেই, তাই আমরা এই দিনের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সেদিনই আমরা কর্টসওল্ডের বারফোর্ডে যাই। সেটা একটা অনিন্দ্যসুন্দর জায়গা। বরফে আচ্ছাদিত ছোট্ট এক শহর। চারপাশে অসম্ভব ঠান্ডা। তাই মানুষরা কফি শপে আড্ডা দিচ্ছিল। আমরাও একটি কফি শপে যাই এবং হট চকলেট খাই। আমরা দেখলাম, মানুষজন ব্রিটিশদের প্রিয় খাবার ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস’ খাচ্ছেন। আমাদের আবাসিক পথপ্রদর্শক জানালেন, গ্রীষ্ম মৌসুমে এই জায়গা নাকি আরও অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে ওঠে।
কোর্সের অংশ হিসেবে বিল স্পেকট্রা নামের গাইডের সঙ্গে ভৌতিক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয় আমাদের। তিনি অক্সফোর্ডের অন্যতম জনপ্রিয় এক ভৌতিক ভ্রমণ গাইড। তিনি ভিক্টোরিয়ান আন্ডারটেকার ধরনের পোশাক পড়ে আমাদের সামনে এলেন। আমরা তার সঙ্গে অক্সফোর্ডের রাস্তা ধরে বিভিন্ন পৌরাণিক জায়গায় হেঁটেছিলাম। যাত্রাপথে তিনি আমাদেরকে ভয়ঙ্কর সব গল্প শোনাচ্ছিলেন, যা শুনে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। মাঝে মাঝে তিনি অবশ্য হাসির গল্পও শোনাচ্ছিলেন। সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল, তিনি আমার জন্মমাস উপলক্ষে তার জাদুকরি প্রতিভার মাধ্যমে একটি কাগজের টুপি বানিয়ে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এরপর আমার জন্মদিনে নৈশভোজের পর আমাদের আবাসিক পথপ্রদর্শক আমাদের দলকে নিয়ে অক্সফোর্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত আইসক্রিম পার্লার জর্জ অ্যান্ড ডেনভারে নিয়ে যান। আমরা সেখানে এক মজার সময় কাটাই।
কোর্সের অংশ হিসেবে আমাদেরকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। কোর্সের শেষ দিনে আমাদেরকে একটি প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। আমরা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে যাওয়া তিনজন শিক্ষার্থী ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’ শিরোনামে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করি। শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ভীষণ উৎসুক ছিলেন কারণ তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশি জানতেন না। প্রেজেন্টেশন দেখার পর তাদের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ছিল অবিস্মরণীয় এবং ইতিবাচক। আমাদের ঐহ্যিবাহী পোশাক দেখে তারা ভীষণ আনন্দিত ছিলেন। আমার মেন্টর হেইলি বলেন, আমরা কোনো গ্রুপকেই সাধারণত ‘অসাধারণ’ বলি না, কিন্তু তোমাদের প্রেজেন্টেশন দেখার পর ‘অসাধারণ’ বলতে বাধ্য হচ্ছি।
এরপর দুই দিন ছিল কুইজ নাইট ও কারাওয়াক নাইট। এটা ছিল আনন্দে পরিপূর্ণ দুই রাত, এবং পরস্পরকে জানার একটি ভালো মাধ্যম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মধ্যে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ বন্ধন তৈরি হয়।
আমাদের কোর্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ছিল গালা ডিনার। ওইদিন প্রত্যেকেই পড়েছিল ফরমাল পোশাক এবং সবকিছুই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশদের আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে। এমনকি খাবার পরিবেশনও করা হয়েছিল ব্রিটিশ পদ্ধতিতে। সেই রাতেই আমাদেরকে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। শিক্ষকরা আমাদের উদ্দেশ্যে গান পরিবেশন করেন। এদিন আমরা প্রত্যেকেই ছিলাম আনন্দিত এবং একইসঙ্গে দুঃখিত। কারণ এদিন ছিল আমাদের কোর্সের শেষ দিন। আমরা এই সফরে বেশ কজন জাপানি বন্ধু পেয়েছি।
অক্সফোর্ডে অবস্থানকালে আমরা বেশকিছু জায়গা ভ্রমণ করেছি। যেমন: পিট রিভার্স মিউজিয়াম, ক্রাইস্ট চার্চ ক্যাথিড্রাল, র্যাডক্লিফ ক্যামেরা, শেলডোনিয়ান থিয়েটার, নিউ কলেজ, চার্চ অব সেন্ট ম্যারি, ডিভাইনিটি স্কুল, বডলিয়ান লাইব্রেরি, কভার্ড মার্কেট, কর্নমার্কেট স্ট্রিট, অক্সফোর্ড বোটানিক গার্ডেন, কারফ্যাক্স টাওয়ার ইত্যাদি।
অক্সফোর্ডের সবকিছুই মজার। তাদের আছে ভিন্ন ভিন্ন স্থাপত্য নকশা। প্রত্যেক কলেজের রয়েছে নিজস্ব হল। আর আছে নিজস্ব প্রার্থনালয়। আমি এখনো প্রার্থনালয়ের ঘণ্টাধ্বণি মিস করি। এখনো মিস করি অক্সফোর্ডের রাস্তায় রাস্তায় ভায়োলিন ও গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া বৃদ্ধদের।
এই আন্তঃসংস্কৃতি বিনিময় প্রোগ্রাম আমাদেরকে দারুণভাবে বদলে দিয়েছে। আমরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছি। আরও কয়েকটা দিন যদি অক্সফোর্ডে থাকতে পারতাম! অক্সফোর্ডের এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে থাকবে।
অক্সফোর্ডের হার্টফোর্ড কলেজে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অ্যফেয়ার্সকে আন্তরিক ধন্যবাদ।