অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডির স্কলারশিপ
- মুহম্মদ এম জে সিদ্দিকী, ব্রিসবেন (অস্ট্রেলিয়া) থেকে
কীভাবে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপ পাওয়া যায়? স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে কী কী ক্রাইটেরিয়াকে (নির্ণায়ক) বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়? এই রকম প্রশ্নের উত্তর চেয়ে প্রতি মাসেই প্রায় ১০ থেকে ১২টি ইমেইল পাই | গত কয়েক বছর থেকেই এমনটি চলে আসছে | কাজের ফাঁকে যতটুকু পারি সবাইকে সহযোগিতা করতে চেষ্টা করি | আজ ভাবলাম এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু লিখব | যারা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে আসতে চান তাদের জন্য কিছুটা হলেও কাজে আসবে |
গত পাঁচ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্কলারশিপ কমিটিতে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে | বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমার কাজ ছিল আবেদনকারী ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রছাত্রীদের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা | সেই তালিকা থেকেই অনেক যাচাই বাচাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা হতো | অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ হতো | সেখান থেকেই বাছাই করা নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপের জন্য ইনভাইটেশন লেটার পাঠানো হতো | তবে বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের সিভি, ট্রানসক্রিপ্ট, রিকোমেন্ডেশন লেটার এগুলো পড়ে, দেখে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে | তা ছাড়া আমার নিজের ল্যাবেও কিছু বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী নিয়োগ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে | এই অভিজ্ঞতাগুলোর কিছু অংশ স্কলারশিপ প্রার্থী ছাত্রছাত্রীদের কাজে আসতে পারে |
দুই.
অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডির ভর্তি এবং স্কলারশিপের জন্য যারা অ্যাপ্লাই করেন, তাদের অ্যাপ্লিকেশন প্রথমেই তারা কোন দেশ থেকে এসেছেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন, তাদের এডুকেশন লেভেল অস্ট্রেলিয়ার এডুকেশন লেভেলের সমান কিনা—তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো দেশের এডুকেশন লেভেল অস্ট্রেলিয়ার এডুকেশন লেভেলের সমান না হয়, তাহলে সে দেশের মাস্টার্স ডিগ্রিধারী একজন ছাত্র তার দেশের মাস্টার্স ডিগ্রি ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়াতে সরাসরি পিএইচডিতে ভর্তি ও স্কলারশিপের সুযোগ পাবেন না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি কেমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ তা একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করি। অস্ট্রেলিয়া কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্কের অধীনের এক নীতিমালায় অস্ট্রেলিয়া সরকার বাংলাদেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে।
সেকশন ১: মূলত ১৯৭১ সালের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত সকল বিশ্ববিদ্যালয় এই সেকশনের অধীনে আছে। প্রথম ক্যাটাগরিতে রাখার কারণ হিসেবে দুটি বিষয়কে বিবেচনায় আনা হয়েছে। (ক) কোয়ালিফায়েড শিক্ষক, যাঁরা ভালো মানের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম নিশ্চিত করেন। (খ) প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা। যার মাধ্যমে দেশ সেরা ছাত্রছাত্রীদের এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কুয়েট, চুয়েট, ডুয়েট, রুয়েট, কৃষি, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এই সেকশনে স্থান পেয়েছে।
সেকশন ২: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের সকল কলেজ এই সেকশনে পড়েছে। এখানে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধীনস্থ সকল কলেজের শিক্ষামান স্ট্যান্ডার্ড মানের অনেক নিচে। এই সব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের এমপ্লয়মেন্ট আউটকামস ন্যাশনাল লেভেলে তেমন ভালো হয় না। এই সব কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগের বিএসসি বা এমএসসির চেয়ে বেশি উচ্চতর কোনো ডিগ্রি নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে আনা মারাত্মক সমস্যাগুলোকে এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কলেজের পাশাপাশি এই সেকশনে আরও রাখা হয়েছে দেশের প্রায় সবগুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে (ফেনী, বরিশাল, কুমিল্লা, যশোর, পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাকি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়)। খুব অবাক হয়ে আমি খেয়াল করেছি এই সেকশনে ফেলে রাখা হয়েছে দেশের সেরা দুটি বিশ্ববিদ্যালয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে (খুবি)!
সেকশন ৩: ওপরের দুই সেকশনের বাইরে যত প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় সবগুলো এই সেকশনের অধীনে আছে।
এই রকম সেকশনে ভাগ করে যা করা হয়েছে তা বিস্তারিত বোঝাতে নিচে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি |
সেকশন ১-এর অধীনের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন ছাত্র বা ছাত্রী যদি চার বছরের ব্যাচেলর পাস করার পর দুই বছরের মাস্টার্স করে, তবে তার এই দুটি ডিগ্রিকেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাচেলর ও মাস্টার্সের সমপর্যায়ের বলে ধরা হবে। অর্থাৎ এই ছাত্র বা ছাত্রীর পক্ষে বাংলাদেশে মাস্টার্স করে অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য সরাসরি অ্যাপ্লাই করতে পারবে।
সেকশন ২-এর লিস্টেড বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যদি কেউ চার বছরের (অনার্স) ব্যাচেলর করে তবে তার ডিগ্রি অস্ট্রেলিয়ার মূল ব্যাচেলর ডিগ্রির অ্যাসোসিয়েট বলে ধরা হবে। দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রিকেও অস্ট্রেলিয়ার মূল মাস্টার্স ডিগ্রির অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি ভাবা হবে। এই ছাত্র বা ছাত্রী যদি চার বছরের (অনার্স) ব্যাচেলরের পরে আবার দুই বছরের মাস্টার্স করে তবে তার যোগ্যতাকে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাচেলরের সমপর্যায়ের ভাবা হয় (তাও থিসিস ও ডিগ্রির মূল্যায়ন সাপেক্ষে)। তার মানে সেকশন ২-এর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের অনার্স ও দুই বছরের মাস্টার্সের পর অস্ট্রেলিয়াতে কেউ সরাসরি পিএইচডি করতে পারবে না। এমনকি মাস্টার্সে অ্যাপ্লাই করলেও সেটা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বলা যাবে যে, সেই ছাত্র বা ছাত্রী আসলে মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারবে কি না!
আমি কখনো ইনস্টিটিউটের ক্লাসিফিকেশনে বিশ্বাস করি না। কোন ইউনিভার্সিটি ভালো আর কোন ইউনিভার্সিটি খারাপ—এটি আমি সহজে বলতে পারি না। কারণ পুরো বিষয়টিই আমার কাছে আপেক্ষিক বলে মনে হয়। কিন্তু এর পরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলাদেশের অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাবিপ্রবি ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান খারাপ—এটি আমি মেনে নিতে পারব না। ওখানে ভালো মানের শিক্ষক নেই সেটিও মেনে নিতে পারব না। আমার জানা মতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেক ছাত্রছাত্রী অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন ও মূলধারার গবেষণা করছেন। যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে শাবিপ্রবি থেকে বেশি বই কম জার্নাল পেপার হয় না। পত্রিকায় তো দেখি প্রায় প্রতি বছরই শাবিপ্রবির কোনো না কোনো শিক্ষক ইউজিসির গবেষণা এক্সসেলেন্স পুরস্কার পান।
সংগত কারণেই আমি এখানে একটি অনুরোধ করতে চাই। আমাদের শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ কী এই ব্যাপারে ইউজিসির সঙ্গে বা শাবিপ্রবি-খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলাপ করবেন? আমরা যারা এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রী আনতে চাই তাদেরও উপকার হয়, ওই সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রীরাও ঝামেলা থেকে মুক্তি পান।
পিএইচডির ভর্তি ও স্কলারশিপের জন্য এর পরেই যে বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় সেটি হলো অনার্স ও মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট | দুটিতেই সিজিপিএ ৩.৫-এর থেকে বেশি থাকলে ভালো | অস্ট্রেলিয়াতে একাডেমিক স্কোর ৭ স্কেলের মানদণ্ডে মাপা হয় | ৭-এর মধ্যে ৭ হলে তাকে হাই ডিস্টিংশন হিসেবে ধরা হয় | আর ৬ বা ৫ হলে পর্যায়ক্রমে ডিস্টিংশন বা ক্রেডিট হিসেবে ধরা হয় | অস্ট্রেলিয়ার মোটামুটি সব বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডিতে ভর্তির ক্ষেত্রে ক্রেডিটের সমপর্যায়ের বা তার চেয়েও বেশি স্কোরের রেজাল্ট থাকতে হবে | অনার্স ও মাস্টার্সে থিসিস অবশ্যই থাকতে হবে | সেই থিসিস আবার নামেমাত্র হলে হবে না | দুটি থিসিসেই কমপক্ষে ৭০ থেকে ১০০ পৃষ্ঠার হতে হবে (১০ হাজার থেকে ১৪ হাজার শব্দের মাঝে) | থিসিসগুলো থেকে যদি ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে (যেটার ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ৩ বা তার ওপর) একাধিক ভালো পাবলিকেশন থাকলে অ্যাপ্লিকেশন এমনি থেকেই হাইভ্যালুড হয়ে যায় |
ইদানীং একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি | বাংলাদেশ থেকে অনেক ছেলেমেয়ে নামেমাত্র ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল, এমন জার্নালে পাবলিকেশন করছে | এক বছরে সাতটা থেকে ১০টা জার্নাল আর্টিকেল প্রকাশ করেছে এমন অনেক সিভিও পাই | খোঁজ নিয়ে দেখেছি এসব জার্নালের নামধামও কোথাও খুঁজে পাইনি | বেশির ভাগেই ইনডেক্সড জার্নাল না | আইএসআই বা এসসিআই (ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক ইনডেক্স বা সায়েন্স সাইটেশান ইনডেক্স) কোনো ইনডেক্সেই এদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না | এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ এমন নামমাত্র জার্নালে এত বেশি সংখ্যক পাবলিকেশন না করে ভালো মানের জার্নালে দুই-একটি পাবলিকেশন করা বুদ্ধিমানের কাজ | এতে সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রীর কাজের ও রিসার্চ ট্রেনিংয়ের কোয়ালিটি সম্বন্ধে একটি ভালো ধারণা প্রকাশ পায় |
অনেকেই বলেন বাংলাদেশ থেকে ভালো পাবলিকেশনের তেমন সুযোগ নেই | কথাটি ঠিক নয় | একটি উদাহরণ দিই | গত কয়েক বছর ধরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বেশ কয়েকটি গবেষণা দল প্রায় নিয়মিত ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে ভালো মানের পাবলিকেশন করছেন | আর এর ফলস্বরূপ এই বিভাগ থেকে পাস করে অনেক গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশের খুব নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে গবেষণা করছেন | ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, কৃষি, চট্টগ্রাম, খুলনা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে নিয়মিত ভালো মানের পাবলিকেশন প্রকাশিত হচ্ছে | কিন্তু সবার যে সে সুযোগ থকবে তা কিন্তু নয় | আর তা ছাড়া কিছু বিভাগ আছে যাদের হয়তো পাবলিকেশনের তেমন সুযোগেই নেই | তাদের জন্য আমার পরামর্শ হলো বাংলাদেশের তাদের অনার্স ও মাস্টার্সের ভালো ফলাফল দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান বা তাইওয়ান থেকে তারা আরও একটি মাস্টার্স করে ফেলতে পারেন | শুধু এই কয়টি দেশই না, বাংলাদেশের অনার্স ও মাস্টার্সের ভালো রেজাল্ট দিয়ে আরও অনেক দেশেই মাস্টার্সের ভালো সুযোগ করে নেওয়া যায় | এই সুযোগে তারা কয়েকটি ভালো পাবলিকেশন করে ফেলতে পারবেন | আমি নিশ্চিত এই সব দেশের ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মাস্টার্স থাকলে অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে |
এখানে বলে রাখা ভালো যে, অস্ট্রেলিয়াতে মাস্টার্সের স্কলারশিপের সুযোগ অনেক কম | আবার বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সকে অস্ট্রেলিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অনার্সের সমমানের মনে করে না | আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেও জানি যে, এই দুটি অনার্সের মাঝে বিশাল পার্থক্য | বাংলাদেশে যেখানে চার বছরের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি শেষ হলেই ডিগ্রির সঙ্গে অনার্স কথাটি অটোমেটিক লেগে যায়, অস্ট্রেলিয়াতে ব্যাপারটি সেই রকম না | এখানে অনার্সের জন্য ছাত্রছাত্রীদের আলাদা একটি বছর পড়াশোনা করতে হয় | পুরো একটি বছর গবেষণা করতে হয় | এই এক বছর অনার্স ইয়ারে অস্ট্রেলিয়ার ছাত্রছাত্রীরা যা করে তা ইন্টারন্যাশনাল অনেক ছাত্রছাত্রীরা পিএইচডিতে তিন বছরেও তা করতে হিমশিম খায় |
আরেকটি ব্যাপার ইদানীং লক্ষ্য করা যায় | অনেকেই নিজের টাকায় মাস্টার্স করতে অস্ট্রেলিয়াতে আসেন | আমার নিজের ল্যাবেই এমন একজন এসেছেন | যদিও এ ক্ষেত্রে সর্বমোট প্রায় ৬৫ হাজার ডলার টিউশন ফি দিতে হয়, তবুও বলব এটি একটি ভালো ম্যুভ | এসব ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্য থাকে ভালো একটি মাস্টার্সের পরে এই বিশ্ববিদ্যালয় বা অস্ট্রেলিয়ার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির স্কলারশিপ ম্যানেজ করে নেওয়া | কিন্তু মনে রাখতে হবে নিজের টাকায় পড়া এই মাস্টার্স ডিগ্রি যেন ‘মাস্টার্স বাই রিসার্চ’ বা এর সমপর্যায়ের ডিগ্রি হয় | ‘মাস্টার্স বাই কোর্স ওয়ার্ক’ বা এর সমপর্যায়ের ডিগ্রি নিয়ে পিএইচডি ভর্তি বা স্কলারশিপ পেতে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে | শুধু মাস্টার্স বাই কোর্স ওয়ার্ক ডিগ্রিতে যেহেতু রিসার্চ কম্পোনেন্ট থাকবে না তাই পিএইচডিতে ভর্তির পুরো ক্রাইটিরিয়া পূর্ণ হবে না | মাস্টার্স বাই রিসার্চের ক্ষেত্রে ডিগ্রির দুটি কম্পোনেন্ট থাকে—কোর্স ওয়ার্ক ও রিসার্চ প্রজেক্ট | রিসার্চ প্রজেক্টের জন্য ছাত্রছাত্রীদের একটি ল্যাবের অধীনে থাকতে হয়। কোনো ছাত্রছাত্রী যদি কোর্স ওয়ার্কে ভালো রেজাল্ট করেন এবং রিসার্চ প্রজেক্ট অংশেও ভালো কাজ করেন তাহলে তার হোস্ট সুপারভাইজারের রিকোমেন্ডেশনে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই একটা ভালো স্কলারশিপ পেয়ে যান | না পেলে, তার সুপারভাইজার নিজেই একটা ফান্ড ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন (বা দেন) |
তিন.
হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি ও স্কলারশিপের আরেকটি প্রধান শর্ত হলো আইইএলটিএস স্কোর | প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই একটা ন্যূনতম আইইএলটিএস স্কোর চায় | তবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ৬-এর (প্রতিটি ব্যান্ডে) নিচে নেই | যদিও আইইএলটিএস স্কোর দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিকেশন স্কিল সব সময় সঠিকভাবে বোঝা যায় না বোঝা যায় না, এর পরেও যার আইইএলটিএস স্কোর যত ভালো তাকে তত বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় | এখানেই কিন্তু শেষ নয় | যেহেতু সায়েন্টিফিক সব আর্টিকেল, থিসিস, রিপোর্ট ইংরেজিতে লিখতে হবে তাই এই ভাষাটিতে ভালো দখল থাকলে পিএইচডি বা মাস্টার্স ডিগ্রির কাজ অনেক সহজ হয়ে যায় | আমি যত দূর জানি, যখন একজন ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রছাত্রীকে স্কাইপেতে বা সরাসরি ইন্টারভিউতে ডাকা হয় তখন তার কমিউনিকেশন ও লেখার স্কিলকে খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয় |
চার.
আমার দুটি ব্যক্তিগত অবজারভেশনের কথা বলে শেষ করব | প্রথমটি বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের সিভি তৈরি করা নিয়ে | আমার মনে হয় তারা সিভি তৈরিতে খুব আনপ্রফেশনাল ও কাঁচা | পিএইচডি করতে আসা একজন শিক্ষার্থীর সিভিটা খুব ইনফরমেটিভ হতে হয় | যেই ল্যাবে অ্যাপ্লাই করবে সেই ল্যাবের সঙ্গে তার বর্তমান ও নিকট ভবিষ্যতে পরিকল্পিত কাজের মিল আছে কিনা, থাকলেও কীভাবে আছে—সিভিতে এই বিষয়টা পরিষ্কার করে দিতে পারলে বিষয়টি সুপারভাইজারের নজরে আসবে | খুব মার্জিতভাবে তার সকল অভিজ্ঞতার কথা লিখতে হয় | অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকেই এমন সব অভিজ্ঞতার কথা লেখেন যার সঙ্গে তার সিলেবাস বা কারিকুলামের কোনো সংযোগ নেই | সিভিতে ক্লাসে তার অবস্থান (যেমন পঞ্চাশ জন ছাত্রের ক্লাসে প্রথম অথবা ফিজিক্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে ৫০০ জন ছাত্রের মধ্যে ১০তম), অনার্স বা মাস্টার্সে তাদের প্রথম শ্রেণি আছে কিনা, কোনো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে কিনা, পাবলিকেশনের ফুল রেফারেন্স ও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বা সাইটেশন আছে কিনা, কনফারেন্সে অংশ নিয়েছেন কিনা (কোন লেভেলের কনফারেন্স, ওয়েবসাইট অ্যাড্রেস), পোস্টার বা টক দিয়েছেন কিনা—এসব পরিষ্কার করে লেখা ভালো | নিজের সিভি লেখার সময় অন্যেরটা দেখা ভালো কিন্তু কখনো অন্যেরটা কপি করে লেখা ভালো না | এই কাজটি কেমন ক্ষতিকর হতে পারে তার একটি উদাহরণ দিই | ২০১৬ সালে আমি কয়েকজন পিএইচডির ছাত্র নিয়োগ করব এই মর্মে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম | অনেকগুলো সিভি জমা হয়েছিল | এর মধ্যে তিনটি সিভি পড়ে আমার মাথায় হাত | এইগুলো ছিল বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের এবং একই বর্ষের তিনজন ছাত্রের সিভি | প্রতিটি সিভিই একটি আরেকটির ফটোকপি | খুব দয়া করে এরা নিজের সংশ্লিষ্ট অংশগুলো শুধু বদলিয়েছে |
দ্বিতীয় অবজারভেশন হলো বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের রেফারেন্স লেটার নিয়ে | বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা যেসব রেফারেন্স লেটার পাঠায় তার বেশির ভাগই খুব সাদামাটা হয় | কয়েকটি লাইন পড়েই বোঝা যায় খুব অসাবধানে ও গুরুত্বহীনভাবে এটি তৈরি করা হয়েছে | প্রথম প্রথম এই বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জা ও বিব্রত অবস্থায় ফেলত | নিজেকে কলিগদের কাছে খুব ছোট মনে হতো (সম্ভবত আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি বলেই ওরাও এই রেফারেন্সগুলো পড়ে আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাত!) | গত কয়েক বছরে আমি যে সব রেফারেন্স লেটার পেয়েছি তা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের সুপারভাইজারদের দুটি রেফারেন্স লেটারের স্টাইল আমি ধরে ফেললাম | এর একটি অংশে আছে খুব কাঁচা ইংরেজিতে লেখা রেফারেন্স লেটার | এর কারণ (সম্ভবত) এই লেটারগুলো সুপারভাইজারেরা নিজে লেখেন না | লেখে সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রীরা | মাননীয় সুপারভাইজারেরা শুধু নিজের প্যাডে (বা ইমেইলে) এটি কাট অ্যান্ড পেস্ট করেন | রেফারেন্স লেটারগুলোর দ্বিতীয় স্টাইলটি আরও ভয়াবহ—একেই রকম বাক্য, একেই রকম শব্দ | বোঝা যায়, সুপারভাইজারেরা হয়তো রেফারেন্স লেটারের টেমপ্লেইট ব্যবহার করেন | যাকে দেওয়া হবে তার নাম পরিবর্তন করেন আর বাকি টেক্সট অভিন্ন থাকে | কিন্তু এখানে ছাত্রছাত্রীদের একটি বিষয়কে খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে | তাদের মনে রাখতে হবে রেফারেন্স লেটার স্কলারশিপ প্রাপ্তিতে (ডিসিশন মেকিংয়ে) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে | তাই রেফারেন্স লেটার হতে হবে সুন্দর ও শুদ্ধ ইংরেজিতে লেখা-ছাত্রছাত্রীদের অভিজ্ঞতার মার্জিত কিন্তু পরিপূর্ণ মুখপত্র | রেফারেন্স লেটারে পরিষ্কারভাবে বলতে হবে কোথায় ছাত্র বা ছাত্রীটি দুর্বল ও কোথায় তার নৈপুণ্যতা (স্ট্রেন্থ) | একই সঙ্গে রেফারেন্স লেটারেই বলতে হবে প্রস্তাবিত প্রজেক্টের সঙ্গে ছাত্র বা ছাত্রীটির অভিজ্ঞতা কীভাবে এলাইন্ড।
ড. মুহম্মদ এম জে সিদ্দিকী (শামিম): বিজ্ঞানী ও শিক্ষক, গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া |