না খেয়ে ওজন কমানো কি ঠিক?
- রিফাত তানজিম চেতনা
না খেয়ে ওজন কমানোর প্রবণতা ইদানীং একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আমরা এখন প্রায় সবাই-ই বেশ স্বাস্থ্য সচেতন। কেউই সুস্বাস্থ্যের প্রশ্নে এক চুলও ছাড় দিতে চান না। আর সুস্বাস্থ্য গঠনের প্রধান একটি উপায় হচ্ছে, পরিমিত খাবার বা ব্যালেন্সড ডায়েট।
আগে এই ডায়েট কন্ট্রোল করার জন্য পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যতালিকা পেতে আমাদের যেতে হতো চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু এখন সেই প্রয়োজন খুব একটা হয় না। এটিও ইন্টানেটের কল্যাণেই! কারণ চট করে গুগল করলেই সব রকম তথ্য পেয়ে যেতে পারি আমরা। তাই আর কষ্ট করে বাসার পাশের পুষ্টিবিদের সাথে সাক্ষাৎ করার প্রয়োজন ও সময় কোনোটিই আমাদের হয়ে ওঠে না! যাইহোক, ইন্টারনেট বর্তমানে আমাদের ওজন কমানোর ক্ষেত্রে যে উপকারী তথ্যটি বেশি দিচ্ছে, তা হলো- কোনো প্রকার শারীরিক কসরত ছাড়াই কীভাবে ওজন কমানো যায়।
এই তথ্য সার্চ করতে গেলেই, বিশ্বব্যাপী না খেয়ে ওজন কমানোর প্রয়াস, চেষ্টা ও ফলাফল সম্পর্কিত বিভিন্ন অভিনব তথ্য আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়। না খেয়ে ওজন কমানোর ফলাফল বেশ আশানুরূপ। তাই আমরা এই উপায়ে ওজন কমাতে বেশ তৎপরতা দেখাচ্ছি। ওজন কমানোর এই উপায়টি মূলত আসে এইঙ্গেস বারবিয়েরির ওজন কমানোর গল্প থেকে।
এইঙ্গেস বারবিয়েরি একজন স্কটিশ, যার ওজন ছিল মাত্রাতিরিক্ত, ২০৬ কেজি। তার বয়স যখন ২৬ বছর, তখন তিনি ওজন কমাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেই ভাবা, সেই কাজ! ওজন কমানোর পরামর্শ নেওয়ার জন্য গেলেন ডান্ডি রয়্যাল ইনফার্মারি-এর মেডিসিন বিভাগে। সেখানকার চিকিৎসকেরা তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্ত নেন, তাকে অল্প অল্প করে খাওয়া কমাতে বলবেন। মাত্রাতিরিক্ত ওজনের কারণে, একবারে বেশি সময় ধরে না খেয়ে থাকলে এইঙ্গেস অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কা ছিল তাদের।
চিকিৎসকেরা এটিও জানতেন, এইঙ্গেসকে এই ধরনের ডায়েট চার্ট দিয়েও বিশেষ লাভ হবে না। কারণ এই ডায়েট চার্ট মেনে তিনি ওজন কমাতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু সেটিকে ধরে রাখতে পারবেন না; আবার ওজন বাড়িয়ে ফেলবেন। কিন্তু এইঙ্গেস ছিলেন অনড়। ৩৮২ দিন না খেয়ে থেকে ২০৬ কেজি থেকে ওজন একলাফে নামিয়ে আনেন ৮২ কেজিতে!
কেবল চিকিৎসকেরাই নয়, হতবাক হয়ে যায় বিশ্ববাসী। ঐ এক বছর এইঙ্গেস শুধু পানি, চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি ও রঙ চা এবং সেই সাথে কিছু সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ভিটামিন খেয়ে টিকে ছিলেন। মাঝেমধ্যে চিনি ও দুধ মিশিয়ে চা, কফি খাওয়ার অনুমতি মিলতো চিকিৎসকের কাছ থেকে। প্রথম দিকে তিনি ১ সপ্তাহ অন্তর অন্তর এই সুযোগ পেতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ক্বচিৎ এমন বিশেষ দিন আসতো, যেদিন তিনি চিনি ও দুধ দিয়ে চা খেতে পারতেন। এ বিষয়ে এইঙ্গেস বলেন, এই এক বছর না খেয়ে থেকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম খাবারের স্বাদ কেমন হয়!
ওজন কমানোর দিনগুলো তিনি বেশিরভাগ বাসাতেই কাটাতেন, আর চেকআপের জন্য নিয়মিত যেতেন চিকিৎসকের কাছে। সেখানে রক্তচাপ পরীক্ষা করে জানা যায়, এইঙ্গেস একদম না খেয়ে আছেন।
পানি ছাড়া বড়জোর মানুষ এক সপ্তাহ বাঁচতে পারে, আর খাবার ছাড়া কয়েক সপ্তাহ। ৪০ দিনের বেশি সময় না খেয়ে থাকাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ। এতে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু এইঙ্গেসের ওজন কমানোর প্রত্যয় এতটা দৃঢ় ছিল যে, ঈশ্বরও যেন তাকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়েছেন!
এভাবে যখন এইঙ্গেস তার লক্ষ্যে পৌঁছে যান এবং ওজন ১২৫ কেজি কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হন, তখন থেকে তিনি খাবার ছুঁয়ে দেখতে শুরু করেন। ওজন ৮১ কেজিতে নেমে আসার পরে তার প্রতিদিনের খাবার ছিল ১টা সেদ্ধ ডিম, মাখন লাগানো এক পিস পাউরুটি আর এক কাপ ব্ল্যাক কফি। এইঙ্গেসের মতে, এই ডিমটাই তার পেট পুরোপুরি ভরিয়ে দেয়।
এইঙ্গেস এমন লম্বা সময় না খেয়ে থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পেরেছে বলেই আবার ভেবে বসবেন না যে, আপনিও এটা পারবেন। হ্যাঁ, না খেয়ে থাকতে পারা ভালো। এটা আপনার বয়স ধরে রাখবে; আপনার ত্বকে সহজে বয়সের ছাপ পড়তে দেবে না, অনেক মরণব্যাধি থেকে রক্ষা পাবেন আপনি, ক্যান্সারের কোষগুলো মারা যাবে তাদের পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে। কিন্তু এগুলো একটা সাময়িক সুস্থতা। দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকলে হয়তো এখন আপনার অনেক উপকার হবে, কিন্তু একটু বয়স বাড়লে বুঝতে পারবেন, কী বিপত্তিটাই না ঘটিয়ে এসেছেন এতদিন ধরে!
দীর্ঘদিন বা দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকার জন্য শরীরে দানা বাঁধবে নানা রকম রোগ। আপনি জানেন তো, বয়স বাড়লে আমাদের এত অসুখবিসুখ কেন হয়? বয়স বাড়লে আমাদের খাওয়ার পরিমাণটা অনেকাংশে কমে আসে। আমরা আগের মতো খেতে পারি না এবং আমাদের দেহে খাবারের চাহিদা থেকেই যায়। সুতরাং বলা চলে, আমরা শরীরের পর্যাপ্ত পুষ্টিটা গ্রহণ করতে পারি না। এই কারণেই বয়স হলে আমাদের শরীরে একগাদা অসুখবিসুখ বাসা বাঁধে।
এবার আসা যাক রোযা থাকা প্রসঙ্গে।
“রোজা থাকাটাও তো অনেক সময় ধরে না খেয়ে থাকা। অন্য সময় না খেয়ে থাকার কারণে শরীরে এত এত জটিলতা সৃষ্টি হয়, তাহলে রোজা করলে শারীরিক ক্ষতি হয় না কেন?”, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে আসতেই পারে।
রমজান মাস একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে চলে, এবং এই সময় মুসলিমদের শুধুমাত্র সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে বলা হয়েছে। এর মধ্যবর্তী সময়ে খাওয়াদাওয়া করতে কোন বাধা নেই। তাই কেউ যদি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত না খেয়ে না থাকায় সৃষ্ট ক্যালরি চাহিদা সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সময়ে মিটিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে কোনো ক্ষতিই হবে না। কিন্তু দ্রুত ওজন কমানোর জন্য আমরা তা করি না। ওজন কমাতে আমরা যেটা করি তা হচ্ছে, ২৪ ঘন্টা, ৪৮ ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে না খেয়ে থাকি। স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক এই কাজটি কোনোভাবেই করা যাবে না।
মনে রাখবেন, আমাদের যেমন একদম না খেয়ে থাকা ঠিক নয়, তেমনি অতিরিক্ত খাবার খাওয়াও ঠিক নয়। খাবারের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা এবং সব খাবারের প্রতি রুচি যাদের আছে তাদের ক্ষতিও কম নয় কিন্তু। অতিরিক্ত খাওয়ার সাধারণ সমস্যা তো আমাদের সকলের জানা যে, অতিরিক্ত খেলে ওজন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়, শরীরে চর্বি জমে। ফলে নানান ধরনের অসুস্থতা ভর করে শরীরে। এছাড়াও কিছু সমস্যা আছে, যা সম্পর্কে আমরা সকলে বিশেষভাবে অবগত নই। যারা খেতে খুব ভালোবাসে তাদের রাগ অতিরিক্ত হয়, মেজাজ খিটখিটে থাকে এবং আচরণগত আরও সমস্যা দেখা যায়।
তাই একেবারেই না খেয়ে থাকা ও অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া- এ দুটো অভ্যাসই আমাদের ত্যাগ করা উচিত। আপনি প্রতিদিন মাত্র একবেলা খেতে পারেন, এতে ক্ষতি নেই, কিন্তু একবেলাতেই শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি গ্রহণ করুন। এর চেয়ে অতিরিক্ত বেশি বা কম ক্যালরি মোটেও গ্রহণ করবেন না। অথবা আপনি প্রতিবেলায় অল্প করে খেয়ে সারাদিনে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরিটুকু পুষিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু একেবারে না খেয়ে বা অতিরিক্ত খেয়ে থাকবেন না কখনোই। তাহলেই সুস্থ থাকতে পারবেন, সাথে আপনার আয়ুষ্কালও বৃদ্ধি পাবে।
প্রচ্ছদের ছবি : eveningtelegraph.co.uk
সূত্র: রোর মিডিয়া