এইডস মানেই মৃত্যু নয়
স্বাস্থ্য ডেস্ক: ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস। এই মারণ-ব্যাধী সম্পর্কে আতঙ্ক রয়েছে মানুষের মনে। আরও রয়েছে কিছু প্রচলিত ভ্রান্ত ধ্যানধারণা ও কুসংস্কার। এইডস আসলে কী? এই প্রতিবেদন আপনাকে জানাবে সেই প্রশ্নের উত্তর।
বছর কয়েক আগের কথা। পাঁচ বছর বয়সী অমিতকে (ছদ্ম নাম) স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অমিতের অপরাধ, সে এইচআইভি পজিটিভ। বাবা-মা এইচআইভি পজিটিভ হওয়ায় তার শরীরেও এইচআইভি বাসা বেধেছে। সে কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় অন্য অভিভাবকেরা আপত্তি করেন। যার ফলে শিশুটির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ পাঁচ মাস স্কুল কমিটির সঙ্গে লড়াইয়ের পর অমিত আবার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়।
পাশাপাশি বসলে বা একসঙ্গে খেলাধুলা করলে সেই শিশুর থেকে অন্য শিশুর শরীরেও এইডস-এর ভাইরাস ঢুকবে, এমন আতঙ্ক থেকেই অমিতকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অনেক প্রচারের পরেও এইডস নিয়ে এ রকমের ভ্রান্ত ধারণা আজও অনেকেই পোষণ করেন। আর এ-ও ধরে নেওয়া হয়, এইডস-এর ভাইরাস শরীরে ঢুকলেই অবধারিত মৃত্যু।
বাস্তব হল, ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে এইডস-এর ভাইরাস কখনওই ছড়ায় না। আবার এইডস মানেই মৃত্যু নয়।
চিকিৎসকদের মতে, মূলত চারটি উপায়ে এডস-এর ভাইরাস আমাদের শরীরে আসে।
- ১) অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক।
- ২) মাদক নেওয়ার সময়ে অনেকে মিলে একই সূচ ব্যবহার করলে।
- ৩) এইচআইভি পজিটিভ ব্যাক্তির রক্ত অন্যের শরীরে দেওয়া হলে।
- ৪) গর্ভবতী মা এইচআইভি পজিটিভ হলে বাচ্চারও এইডস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
উপরের এই চারটি কারণ ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে এইডস-এর ভাইরাস সংক্রমিত হয় না। হাঁচি, কাশি থেকে এই ভাইরাস ছড়ায় না। একই স্কুলে পড়লে, পাশাপাশি বসলে, এক সঙ্গে খেলাধুলো বা করমর্দন করলে তো নয়ই। এমনকী, এক ঘরে থাকলেও ছড়ায় না। এডস-এর ভাইরাস জলবাহিত নয়। তাই একই পুকুর বা সুইমিং পুলে স্নান করলে এই ভাইরাস ছড়ায় না।
আমাদের দেশে এডস-এর ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়ায় অনিরাপদ যৌন সংসর্গের মাধ্যমে। অন্তত ৯৫% ক্ষেত্রে এ ভাবেই রোগ ছড়ায়। আর ৩-৪% ক্ষেত্রে এই ভাইরাস ছড়ায় মাদক নেওয়ার নিডল থেকে। আগে রক্তদান থেকেও ছড়াত। কিন্তু বর্তমানে পরীক্ষা করে তবেই অন্যের শরীরে রক্ত দেওয়া হয় বলে এই পদ্ধতিতে এইডস-এর ভাইরাস খুব কমই ছড়ায়।
অসুখটা কী ?
এইডস-এর ভাইরাসের নাম হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। এই ভাইরাস নিজে কোনও রোগ তৈরি করে না। শরীরের কোনও অঙ্গকে বিকল করে দেয় না। শুধু শ্বেত রক্তকণিকার সিডি-৪ লিম্ফোসাইট কোষকে খেয়ে ফেলে। এই কোষই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। যার ফলে অন্য কোনও ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া শরীরে ঢুকতে বাধা পায়। এইচআইভি ভাইরাস এই কোষকে খেয়ে নেওয়ায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে। তখন যে কোনও ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া সহজে শরীরে বাসা বাঁধে। প্রথমে জ্বর, পেট খারাপ, সর্দিকাশির মতো ছোটখাট অসুখ দিয়ে শুরু হয়। পরে নানা জটিল রোগ বাসা বাঁধতে থাকে।
মুশকিল হল, এই ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা খুব আস্তে আস্তে কমে। তাই প্রথম দিকে কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না। একে বলে উইন্ডো পিরিয়ড। মোটামুটি ভাবে পাঁচ-সাত বছর পর গিয়ে ব্যাপারটা টের পাওয়া যায়। তখন হয়তো জ্বর হল। ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও সেই জ্বর কমছে না। এক জন যৌনকর্মীর শরীরে হয়তো এই ভাইরাস ঢুকেছে। প্রথম দিকে কোনও রকম উপসর্গ না থাকায় তিনি নিজেও ব্যাপারটা জানেন না। পাঁচ বছর পর গিয়ে দেখা গেল তাঁর জ্বর বা অন্য কোনও অসুখ হয়েছে। যা সারতেই চাইছে না। সে সময়ে রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ল এইচআইভি-র উপস্থিতি। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই হয়তো তাঁর হাজারখানেক ক্লায়েন্টের সঙ্গে কোনও রকম সুরক্ষা না নিয়ে যৌনসম্পর্ক করেছেন। ফলে তাদের শরীরেও সেই ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। এ ভাবেই ছড়ায় এইডস।
ভাইরাসের উপস্থিতি কীভাবে টের পাওয়া যায়:
কারও হয়তো পেট খারাপ হয়েছে। কিন্তু ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই সারছে না। মাসখানেক ধরে চলছে। বা কারও জ্বর একটানা মাস দেড়েক ধরে চলছে। বা কয়েক মাসের মধ্যে ওজন ভীষণভাবে কমে গিয়েছে। তখন দেখা হয়, সেই ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে কি না।
যৌনকর্মী বা যারা নিয়মতি ড্রাগ নেয় বা অন্য কোনও ঝুঁকিসম্পন্ন মানুষের প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ত পরীক্ষা করলে ভাইরাস আছে কি না বোঝা যায়। গর্ভবতী মায়ের বা অন্য কারও অস্ত্রপাচারের আগে রুটিন টেস্ট করালে এইডস-এর ভাইরাস আছে কি না বোঝা যায়।
এইচআইভি মানেই এইডস নয়:
কারও রক্তে এইচআইভি ভাইরাস পাওয়া গেলেই সে এইডস আক্রান্ত নয়। এইডস তখনই হয়, যখন শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে নানা রোগ বাসা বাঁধতে থাকে।
এইচআইভি পজিটিভ হলে:
এক সময় ধারণা ছিল এইডস মানেই মৃত্যু। কিন্তু মোটেই তা নয়। নিয়মিত চিকিৎসা করালে এইডস রোগী বহু দিন সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকেন। এ জন্য রোগীকে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। মুশকিল হল, ওষুধ খেয়ে ভাল হয়ে যাওয়ার পর অনেক রোগীই আর ওষুধ খেতে চান না। তাঁদের প্রশ্ন, ভাল হয়ে গেছি। তবে আর ওষুধ কেন? তা ছাড়া এই রোগে বাইরে থেকে যেহেতু কিছু দেখা যায় না, তাই রোগীরা ধরেই নেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু ওষুধ বন্ধ করলে যে এইচআইভি ভাইরাস আবার রক্তকণিকার সিডি-৪ লিম্ফোসাইট কোষকে খেতে খেতে শেষ করে দেবে, আর পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমতে থাকবে, সেটা তাঁরা বুঝতে পারেন না। প্রেসার, সুগারের মতো এইচআইভি-র ওষুধ জীবনভর খেয়ে যেতে হয়। তবেই রোগী সুস্থ থাকবেন। ওষুধ বন্ধ করে দিলে তার ফল মারাত্মক হয়।