পানি যখন ঔষধি
- রাফিয়া আলম
তৃষ্ণার্তের সামনে রাখা এক গ্লাস সুপেয় পানি আর রত্নভান্ডার, কোনো একটি বেছে নিতে হলে তিনি যে পানিই নেবেন, তা আর বলতে। পানির অপর নাম যে জীবন। পানির এক ভিন্ন পরিবেশনপদ্ধতি হলো ডিটক্স ওয়াটার। ডিটক্স ওয়াটার হলো ফল, সবজি বা ঔষধি উপাদান মেশানো পানি। আদা, পুদিনাপাতা, এলাচি, দারুচিনি, তেজপাতা, লেবু, শসা, তরমুজ, স্ট্রবেরি, আপেল, কমলা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয় ডিটক্স ওয়াটার। কী এর উপকার, কীই-বা প্রয়োজন, সেটাই জেনে নিন আজ।
খাদ্যাভ্যাসে পানি
সুষম খাদ্যাভ্যাসে পর্যাপ্ত পানিও একটি উপাদান। কেউ কেউ শুধু পানি খুব একটা পান করতে পারেন না। এর পরিবর্তে হয়তো কার্বোনেটেড ড্রিংকস কিংবা ফলের রস পান করেন। এভাবে পানি তো শরীরে ঢুকছে, কিন্তু পানির সঙ্গে ঢুকছে প্রচুর ক্যালরি। প্রতিনিয়ত এভাবে এতটা শর্করা গ্রহণ করা কারও জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়। এর চেয়ে ডিটক্স ওয়াটার ভালো। অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের ভয় থাকে না। পর্যাপ্ত পানি পান করার ফলে শরীরের পানির চাহিদা পূরণ হবে। আপনি সুস্থও থাকবেন। ত্বক ও চুলের সুস্থতায়ও পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্মরোগ বিভাগের অধ্যাপক হরষিত কুমার পাল জানালেন, ভাত খাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে আধা গ্লাস বা এক গ্লাস পানি পান করলে ভাতের পরিমাণ আপনা-আপনিই কমে আসে। এ অভ্যাস তৈরি করলে তা একসময় ওজন নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে। পানির পরিবর্তে ডিটক্স পানি পান করতে পারেন। তবে শরীরচর্চার গুরুত্বও অস্বীকার করার উপায় নেই। মুক্ত বাতাস, সঠিক খাদ্যাভ্যাস আর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনে যতটা সম্ভব কম থাকা—এগুলোই আজকের দিনে সুস্থতার মূলমন্ত্র।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ এবং খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, আধা লিটার ডিটক্স ওয়াটার খুব অল্প সময়ের জন্য শরীরের বিপাক ক্রিয়ার হার ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ ডিটক্স ওয়াটার পরোক্ষভাবে ক্যালরি পোড়াতে সাহায্য করে। শরীরে পানি, লবণ ও পিএইচের মাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে, হজমক্ষমতা বাড়ায়। অল্পতেই ক্লান্তি আসে না, মনও ভালো থাকে। তবে এটি সরাসরি কোনো কাজ করে না, বরং নানাভাবে সাহায্য করে।
সত্যরে লও সহজে
বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই—এমন কিছু ধারণা সমাজে প্রচলিত রয়েছে, বিশেষজ্ঞরা জানালেন সঠিক তথ্য—
ডিটক্স ওয়াটার শরীরের সব বিষ বা টক্সিন দূর করে। এটি একেবারেই ভিত্তিহীন। তবে পর্যাপ্ত পানি খাওয়া হচ্ছে বলে মূত্র ও মলের মাধ্যমে শরীরের বর্জ্য বেরিয়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিংবা উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা—এগুলো প্রতিরোধে বা নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা নেই।
খেয়াল রাখুন
অ্যাসিডিটি, আলসার, পেট জ্বালাপোড়া বা পেটের অন্যান্য সমস্যা থাকলে কোনো কোনো উপাদানে সমস্যা বাড়তে পারে। তাই যাঁরা এ রকম সমস্যায় ভুগছেন, তাঁরা ডিটক্স পানি পান করতে চাইলে পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হতে পারেন।
যেভাবে তৈরি করবেন
হার্বস আয়ুর্বেদিক ক্লিনিকের আয়ুর্বেদিক রূপবিশেষজ্ঞ আফরিন মৌসুমি জানালেন কয়েক রকম ডিটক্স ওয়াটার তৈরির উপায়—
মেথি ধুয়ে শুকিয়ে নিন। রোদে শুকিয়ে নিতে পারলে ভালো। তবে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কিংবা চুলায়ও শুকিয়ে নেওয়া যায়। শুকানোর পর কাচের বয়ামে রেখে দিন। প্রতিদিন ঘুমের আগে এক গ্লাস ফুটন্ত পানিতে ১ টেবিল চামচ মেথি দিয়ে রাখুন। সকালে ছেঁকে নিয়ে খালি পেটে পান করুন।
১ লিটার পানিতে ৭টি খেজুর ভিজিয়ে রাখুন। পরিমাণ কমও হতে পারে (যেমন: ২৫০ মিলিলিটার পানিতে ৩টা)। ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর হাত দিয়ে খানিকটা মিশিয়ে নিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। বাইরে যাওয়ার আগে পান করতে পারেন। বেশি পরিমাণে করা থাকলে বাইরে যাওয়ার সময়ও পানির পরিবর্তে সঙ্গে রাখতে পারেন। একই পদ্ধতিতে কিশমিশও কাজে লাগাতে পারেন (অনুপাতটা একটু আলাদা হবে, ১ লিটার পানির জন্য ২৫টি কিশমিশ কিংবা ২৫০ মিলিলিটারের জন্য ১০টি)। ফ্রিজে রেখেও পান করা যায় সারা দিন। ক্লান্তি কম অনুভব করবেন।
বাইরে গেলে সঙ্গে রাখতে পারেন অন্য একটি পানীয়ও। ১ লিটার পানিতে থেঁতো করা আদা (৩ ইঞ্চি পরিমাণ, কুচি করেও নেওয়া যায়, তবে থেঁতো করাই ভালো), পুদিনাপাতা (৮-১০টি, হাত দিয়ে মিশমিশে করে), বীজ ও খোসা ছাড়া থেঁতো করা শসা (১ টেবিল চামচ) ও লেবুর খোসার কুচি (১ টেবিল চামচ) দিয়ে এক ঘণ্টা পর থেকে পান করা যাবে। সারা দিনে অল্প অল্প করে বারবার পান করতে পারেন।
আধা গ্লাস কুসুম গরম পানিতে আধা কাপ মাল্টার রস ও ৩ চা-চামচ মধু মিশিয়ে নিয়মিত পান করলে ত্বক ও চুল ভেতর থেকে সুন্দর ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
শুকনা হরীতকী, আমলকী ও বহেরা ধুয়ে শুকিয়ে নিন (মেথির মতো নিয়মে, কাচের বয়ামে রেখেও দিতে পারেন)। ১ কাপ ফুটন্ত পানিতে ৩টি হরীতকী, ৬টি আমলকী ও ৩টি বহেরা ভিজিয়ে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ঢেকে রাখার পর ছেঁকে নিয়ে পান করতে হবে (হাত দিয়ে একটু মিশিয়ে নিয়েও ছাঁকতে পারেন) অবশ্যই ভরা পেটে।
সূত্র: প্রথম আলো