ভাইরাস রুখবে যেসব ভিটামিন
- ডা. তানজিনা হোসেন
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ সংক্রমণ মহামারি শুরু হওয়ার গোড়া থেকেই নানা ভিটামিন ও খনিজ গ্রহণের বিষয়টির দিকে বিশ্বজুড়েই আলোচনা হচ্ছে। ছোট-বড় প্রায় সবাই ভিটামিন মিনারেল সাপ্লিমেন্ট খেতে শুরু করেছেন এ সময়। আসলে এটা কতখানি উপকারী, আর এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য–উপাত্তই বা কী?
গত বছরের শেষের দিকে চীনের উহানে যখন প্রথম কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, তখন থেকেই বলা হচ্ছিল যে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি যাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা এ রোগের বিশেষ ঝুঁকিতে থাকবেন। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার একটা অন্যতম কারণ হলো অপুষ্টি আর ভিটামিন, খনিজের অভাব। এর আগে নানা গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনের ঘাটতি নানা ধরনের সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমন, যেসব শিশুর ভিটামিন–এ ঘাটতি আছে, তাদের হাম, ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেশি হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ও হেপাটাইটিসের সঙ্গে ভিটামিন ডির সম্পর্ক এরই মধ্যে প্রমাণিত।
কোভিড-১৯–এর সঙ্গে ভিটামিন ডির সম্পর্ক নিয়ে দুনিয়াজুড়ে গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, শীতপ্রধান দেশে, বিশেষ করে যে মাসগুলোতে দিনের পরিধি আর সূর্যের আলো সবচেয়ে কম ছিল, তখনই এই ভাইরাস সবচেয়ে বেশি মানুষকে আক্রমণ করেছে। ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন যে যাঁদের ভিটামিন ডি স্বল্পতা আছে, তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ (১৭ শতাংশ) কোভিড-১৯–জনিত জটিলতা বা মৃত্যুর শিকার হয়েছে। সম্প্রতি চীনের একটি গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানী লি ঝ্যাং ও ইউনহুই লুই পরামর্শ দেন যে শুধু ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি নয়, এর সঙ্গে কোভিড-১৯ রোগী বা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের ওমেগা৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, জিংক, সেলেনিয়াম, আয়রন, ভিটামিন বি ইত্যাদিরও দরকার হবে।
এসব বিবেচনা করে গত মার্চ মাসে ইএসপিইএন (ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন অ্যান্ড মেটাবলিজম) কোভিড–১৯ সংক্রান্ত একটি গাইডলাইনে সুপারিশ করে যে কোভিড-১৯–এর ঝুঁকি কমাতে এ সময় চাহিদা বুঝে দৈনিক ভিটামিন ও প্রয়োজনীয় খনিজ সাপ্লিমেন্ট হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক, বৃদ্ধ, যাঁদের খাবারের রুচি কম, ডায়াবেটিস, কিডনি বা হৃদ্রোগ আছে, এমন ব্যক্তি ও অপুষ্টির শিকার সবাইকে এই পরামর্শ দেওয়া যায়।
লকডাউনের সময়ে ঘরে আবদ্ধ থাকার কারণে অনেকেই সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে এই মুহূর্তে অনেকেই ভিটামিন ডির অভাবে ভুগছেন বলে ধারণা করছেন। কারও যদি ভিটামিন ডির মাত্রা পরীক্ষা না করাও থাকে, তবু দৈনিক চাহিদা পূরণে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন। তবে একই সঙ্গে খাদ্য গ্রহণ ও সূর্যের আলো গ্রহণের দিকেও মনোযোগী হতে হবে।
এখন দেখা যাক আমরা দৈনন্দিন খাবারে কী পরিবর্তন আনতে পারি এ সময়।
ভিটামিন সি
একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের দৈনিক ৯০ মিলিগ্রাম, আর একজন নারীর দৈনিক ৭৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি দরকার হয়। কিন্তু ধূমপায়ীদের লাগবে আরও বাড়তি ৩৫ মিলিগ্রাম। অন্তঃসত্ত্বা নারীর দৈনিক ৮৫ মিলিগ্রাম আর স্তন্যদানকারী মায়ের দৈনিক ১২০ মিলিগ্রাম।
ফলমূল ও শাকসবজি থেকে যথেষ্ট ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এ সময় টক ফল যেমন লেবু, কমলালেবু, মালটা, জাম্বুরা, টমেটো, আমড়া ইত্যাদি ফলের পাশে সবুজ শাকসবজি যেমন শাক, ব্রকলি, ক্যাপসিকাম, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি খেতে হবে। একটা কমলা বা লেবুজাতীয় ফলে ৭০ থেকে ৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি পাবেন। আমাদের নৈমিত্তিক খাবারে প্রচুর ভিটামিন সি আছে, তাই সবার এই সাপ্লিমেন্ট দরকার হবে না। কিন্তু ধূমপায়ী, বয়স্ক ব্যক্তি, যেসব শিশু ব্রেস্ট ফিডিং না করে তোলা দুধ গ্রহণ করে, যাদের হজম বা বিপাক সমস্যা আছে, তাদের সাপ্লিমেন্ট দেওয়া যেতে পারে।
ভিটামিন ডি
স্বাভাবিক সময়ে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৬০০ থেকে ৮০০ ইউনিট ভিটামিন ডি দরকার হয়। কিন্তু কোভিড মহামারির এই সময়ে এর বাইরে দৈনিক ১০০০ থেকে ২০০০ ইউনিট সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পরামর্শ দিচ্ছেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক জোআন ম্যানসন। সূর্যের আলোতে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি পাওয়া যায়, তাই বেলা ১১টা থেকে ৩টার মধ্যে অন্তত ৩০-৪০ মিনিট শরীরে রোদ লাগানো উচিত। এ ছাড়া সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, বাদাম, ফর্টিফাইড দুধ বা দইয়ে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
জিংক
জিংক সংক্রমণ প্রতিরোধে আর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। চিকিৎসকেরা অনেক আগে থেকেই ডায়রিয়া বা নিউমোনিয়ার সময় শিশুদের জিংক সাপ্লিমেন্ট দিয়ে আসছেন। কোভিড-১৯ মহামারির সময় জিংকের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়েছে। মাংস, বীজজাতীয় খাবার, বাদাম, গোটা শস্যে আছে জিংক। মহামারির সময় সাপ্লিমেন্ট খাওয়া যাবে, কিন্তু তা যেন দৈনিক ৪০ মিলিগ্রামের (শিশুদের জন্য ৪ মিলিগ্রাম) বেশি না হয়।
সঠিক পুষ্টি, আমিষ, ভিটামিন ও খনিজের সুষম সমন্বয় আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই এ সময় পুষ্টিকর সুষম খাদ্যাভ্যাসের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন, কেবল ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট আপনাকে করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে না। নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই একে প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হরমোন ও বিপাক বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
সূত্র: প্রথম আলো