মূকাভিনয়!
- আব্দুল্লাহ আল রাউফ
“আমি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসি, কারণ তখন কেউ আমার কান্না দেখতে পায় না”
এই উক্তিটি তার, যিনি নিজের চোখের পানি আড়াল করে শুধু মূকাভিনয়ের মাধ্যমে অগণিত মানুষকে হাসিয়েছেন, জায়গা করে নিয়েছেন অসংখ্য ভক্তের হৃদয়ে।
স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র ওরফে ‘চার্লি চ্যাপলিন’ জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল। নির্বাক-কমেডিতে বিশ্বরূপ দেখিয়ে গেছেন এই অভিনেতা। জন্ম এবং মৃত্যুর এত বছর পর আজও একইভাবে প্রশংসিত তিনি। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তিনি করতেন তার অভাবনীয় পরিবেশনা ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। এত বছর পরেও জ্বলজ্বল করে উঠে তার মূকাভিনয়ের কীর্তি।
মূকাভিনয় একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম। এটি মূলত মুখে শব্দ না করে বা সংলাপ ব্যবহার না করে শারীরিক বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা ।নাট্যশিল্প অথবা অভিনয়ের এক বিশেষ দিক হচ্ছে এই মূকাভিনয় । বস্তুর অস্তিত্ব না থাকা সত্বেও দৃষ্টি বিভ্রমের মাধ্যমে অর্থাৎ দর্শকের চোখে ভ্রান্তি ঘটিয়ে সেই বস্তুকে অস্তিত্ব দেওয়ার এক আকর্ষণীয় কৌশল হচ্ছে মূকাভিনয়। প্রাচীন রোমান যুগে এই শিল্পের প্রথম চর্চার ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অনেক জায়গায় এর চর্চা হয়েছে। গ্রিসে সম্ভবত প্রথম “Pantomime” নামের একজন মুখোশ পরিহিত অভিনেতা মূকাভিনয় প্রদর্শন করেছিলেন। “Pantomime” একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ ‘বিশুদ্ধ অনুকৃতি’।
মূকাভিনয়ের জনক বলা হয় ফ্রান্সের মার্সেল মার্সোকে তারপরেই গূরুত্ব দেওয়া হয় ফ্রান্সের নাইট উপাধি পাওয়া বাংলাদেশের গর্ব পার্থ প্রতিম মজুমদার কে।
বাংলাদেশে আধুনিক মূকাভিনয়ের চর্চা শুরু হয় ১৯৭৫ সাল থেকে। বিটিভির “যদি কিছু মনে না করেন’ ও ‘বলাবাহূল্য’ অনুষ্ঠানে প্রায়ই মূকাভিনয় দেখাতেন পার্থ প্রতিম মজুমদার । তখন থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মঞ্চে একক মূকাভিনয় প্রদর্শিত হয়েছে। সেগুলি ছিল স্বল্প সময়ব্যাপী এবং সংখ্যায়ও কম। শিল্পীর পোশাকের ধরন প্রায় একই রকম হতো কালো রঙের আচ্ছাদন এবং মুখে সাদা রংয়ের প্রলেপ। বিষয়বস্ত্ত ছিল অত্যন্ত হালকা ও বিনোদনধর্মী। তবে নানা রকম সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তখন যে কয়েকটি ভাল প্রদর্শনী হয়েছে সেগুলির মধ্যে রয়েছে জন্ম থেকে মৃত্যু, বালক ও পাখি, প্রজাপতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফটোগ্রাফার, ঔষধ বিক্রেতা, বখাটে ছেলের পরিণতি, রিকশাওয়ালা, মাছ ধরা ইতাদি। এগুলিতে ক্যারিকেচার এবং অহেতুক হাস্যকৌতুকের স্থলে ক্ষেত্রবিশেষে বিষয়ের গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে।
শুরুর দিক থেকে মূকাভিনয়ের উপস্থাপন রীতির সাথে ব্যঙ্গাত্মক, হাস্যরসাত্মক এবং ভাঁড়ামিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ প্রাধান্য পেয়ে আসলেও শিল্পটি এখন সেখানেই আর সীমাবদ্ধ নেই। মূকাভিনয় এখন শৈল্পিক ও নান্দনিক উপায়ে ফুটিয়ে তোলে সামাজের মানুষের না বলা কথা, অব্যক্ত জ্বালা-যন্ত্রণা, অন্যায়, অবিচার, শাসন-শোষণ, ভালোবাসা আর আকাঙ্ক্ষা। বলা যায় সমাজ সংসারে ঘটে যাওয়া সকল সার্বিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি উঠে আছে মূকাভিনয়ের হাত ধরে৷ মূকাভিনয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব থাকলেও মূকাভিনয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে সচেতনতা বৃদ্ধি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, গণসচেতনতা এবং সংস্কৃতিবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে। রাজনীতির কলুষিত পরিস্থিতিতে মানুষের মুখ যখন বন্ধ হয়ে আসে, কথা বলার অধিকার যখন থাকে না, তখন মূকাভিনয় হয়ে ওঠে কথা বলার বিরাট এক মাধ্যম। এ যেন কিছু না বলেই সবকিছু বলে দেওয়ার এক প্রতিবাদী কণ্ঠ-অস্ত্র। ফরাসি বিপ্লবের সময় তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের বৈপ্লবিক জাগরণে উদ্বুদ্ধ করেছিলো মূকাভিনয়।প্রত্যেকটি শিল্পের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। মূকাভিনয়ের ভাষা হচ্ছে সর্বজনীন ও বোধগম্য । মূকাভিনয় শিল্প বোঝার জন্য দর্শকের মধ্যে কোনো শ্রেণীকরণ প্রয়োজন হয় না। মূকাভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে ভাষা, চিন্তাধারা এবং প্রদর্শিত শিল্পের মর্মার্থ উপলব্ধির ক্ষেত্রে কোনো বৈরিতার জায়গা থাকে না। কারণ, দেশ, কাল, পাত্রভেদে মূকাভিনয়ের সহজ সাবলীল ভাষা সবাইকে পুরনো যোগাযোগের মাঝে নিয়ে যায়। উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করে মুখে না বলে অভিনয়ের মাধ্যমেও কিভাবে প্রতিবাদ করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ মাইম সোসাইটি
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি