দুই চাকার ইতিবৃত্ত
- ধ্রুব ব্যানার্জী
বাহন হিসেবে দুই চাকার কদর বেশ বহুদিনের। যুগের বিবর্তনের সাথে সাথেই সৌখিনতার গণ্ডি পেরিয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দ্বিচক্রযান। পেশিচালিত সাইকেল রূপান্তরিত হয়েছে ইঞ্জিনচালিত মোটরসাইকেলে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিএসএ সাইকেলস কোম্পানির আমদানিকৃত প্রায় ৩৫,০০০ সাইকেল দিয়েই ভারতবর্ষে দ্বিচক্রযানের শুভ সূচনা ঘটে। এরপর সময় কেটেছ প্রায় পঞ্চাশ বছর। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝের দিকে ভারতবর্ষে রয়্যাল এনফিল্ড কোম্পানির মাধ্যমে আগমন ঘটে ইঞ্জিনচালিত দ্বিচক্রযান অর্থাৎ মোটরবাইকের। প্রথমে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য আমদানি করা হলেও, আগমনের প্রথম বছরে বাহনটি জনমনে ব্যপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। এরপর কালের পরিক্রমায় কেটেছে বহু বছর, কুড়ি শতকের এ সময়ে বাজারে এসেছে বহু কোম্পানির উন্নত থেকে উন্নতর মোটরবাইক।
প্রথমদিকে মোটরবাইক শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় বাহন অথবা সৌখিন বস্ত হলেও বর্তমানে জীবিকা নির্বাহের অন্যতম এক মাধ্যম হয়ে উঠেছে ভাড়ায় বাইক চালনা। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে দেশীয় কোম্পানি “পাঠাও”, ঢাকার মাত্রাতিরিক্ত যানজটের কথা মাথায় রেখে মোবাইল অ্যাপভিত্তিক মোটবাইক যাতায়াত সেবা চালু করেন। এরপর ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন। ব্যস্ত নগরবাসী নগরের অসহ্য যানজট হতে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে হয়ে উঠে মোটরবাইকপ্রেমী। এদেশে পাঠাও এর সুদূর সম্ভাবনা দেখে অন্য একটি বিদেশী যাতায়াত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ” উবার”, সেই বছরের নভেম্বর মাসেই তাদের বিভিন্ন ধরনের সেবার মাঝে মোটরবাইককে অন্তর্ভুক্ত করেন। তাদের অন্যান্য বাহন সেবা মোটরবাইকের তুলনায় বেশি ব্যয়বহুল হওয়ায়, নতুন সেবাটি স্বল্প আয়ের উবার ব্যবহারকারীদের কাছে ব্যপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সময়ের সাথে বাজারে আসে ও ভাই, সহজ রাইডসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান।
যাতায়াত ব্যবস্থার আকস্মিক পরিবর্তনে সারাদেশে বেড়ে যায় মোটরবাইক বিক্রয়। যেখানে ২০১৫ তে সারাদেশে মোটরবাইক বিক্রয় হয় ১ লাখ ৮০ হাজার, সেখানে ২০১৭ তে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ লাখ ৮৭ হাজার। যা আগের বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ বেশি। মোটরবাইক কোম্পানিগুলোও নিজেদের ব্যবসা বৃদ্ধিতে এ সুযোগটিকে কাজে লাগান। অল্পদামে জ্বালানি সাশ্রয়ী বিভিন্ন ধরনের মোটরবাইকে বাজার নিজেদের দখলে নেয়ার চেষ্টা শুরু করেন তারা। অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবাদাতা কোম্পানিগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭’ প্রণয়ন করে সরকার। ২০১৮ সালের ৭ মার্চ থেকে সেটি কার্যকর করা হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০১৯ সালের ১লা জুলাই অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স দেয়া শুরু করে। এর মাধ্যমে তারা নির্ধারিত সরকারি কর পরিশোধ করে দ্বিধাহীনভাবে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার সক্ষমতা অর্জন করেন। এতে যাত্রীদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কালক্রমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় বিভাগীয় শহরগুলোতেও এ সেবা বিস্তার লাভ করে।
সারা বিশ্বে চলমান করোনা মহামারীর সময়ে চাকরি হারিয়েছেন বহু মানুষ। মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশও সমপ্রভাবে প্রভাবিত। ‘ট্যাকলিং দ্য কোভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালীব সময়ে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের তরুণদের চাকরিচ্যুতির পরিমাণ মোট প্রায় ২৮ লাখ ৯২ হাজার। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মারণভাইরাস করোনার তাণ্ডবে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৬৬ শতাংশ মানুষ আর গ্রামাঞ্চলের ৪১ শতাংশ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন। এ সংকটে অনেকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন মোটরবাইক পরিসেবা ব্যবস্থাকে।
ঢাকা শহরের ব্যস্ততম সড়কগুলোর মোড়ে মোড়ে অনায়াসেই চোখে পড়ে জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা এসব বাইকারদের। প্রথম অবস্থায় তাদের সেবাসমূহ মোবাইল অ্যাপভিত্তিক হলেও, এখন তারা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সরাসরি যাত্রী পরিবহন করেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে কিছু নীতিমালা ঠিক করে দিলেও, একশ্রেণীর বাইকার এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া গাড়ী চালনা, ট্রাফিক আইন অমান্য করা এবং শেয়ারিং অ্যাপের বিধি-বিধান ও রেজিস্ট্রেশনের বাইরে গিয়ে দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। বাইকারদের উশৃংখল আচরণে এবং নীতিমালার শিথিলতার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা বাড়ছে। গত কয়বছরের নগরীর সকল বাইক দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্যক্তিগত মোটরবাইকের চেয়ে রাইড শেয়ারিং বাইকগুলোর দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। বেশ কিছু ছিনতাইয়ের ঘটনাও জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
পৃথিবীর আদি থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ সবসময় স্বল্প সময় এবং স্বল্প ব্যয়ে অধিক যাত্রার উদ্দেশ্যে যাতায়াত ব্যবস্থাকে অন্য এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ভোক্তা সাধারণের প্রত্যাশা, অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে দেয়া বিশেষ নীতিমালার সুষ্ঠু বাস্তবায়নই পারে সমস্যা দূরীকরণ করে, সম্ভাবনার পথকে সুদূরপ্রসারী করতে। তবেই নগরযাত্রায় আসবে প্রশান্তি, দূর হবে বিশৃঙ্খলা।
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি