অনন্য ইতিহাসে গুপি গাইন বাঘা বাইন
- রিতু প্রমা
গল্প অনেক রকমেরই হয়, কিন্তু কিছু গল্প আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আর সেই গল্প যদি হয় ভূতের রাজার কাছ থেকে জবর জবর তিন বর পাওয়া গুপি গাইন বাঘা বাইনের তাহলেতো কোনো কথাই নেই। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তির ৫২ বছর পরও হয়ে আছে এক অনন্য ইতিহাস।
গুপি গাইন বাঘা বাইন নামটা আমাদের সবারই খুব চেনা।প্রত্যেকটা লোকই জানে এটা এমন একটা গল্প যেটা আট থেকে আশি বাচ্চা থেকে বুঁড়ো সবার ভালো লাগে। বাঙালি অথচ এই সিনেমাটি দেখেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে।
সত্যজিৎ রায় এই নামটা শুনলেই বাঙালির প্রথম মনে আসে পথের পাঁচালী।সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অন্যান্য সিনেমা গুলির মধ্যে গুপি গাইন বাঘা বাইন, হিরোক রাজার দেশে অন্যতম।গুপি গাইন বাঘা বাইন বাংলা চলচিত্র জগৎতে প্রথম মিউজিক্যাল ফিল্ম। সত্যজিৎ পত্নী বিজয়া রায়ের স্মৃতি চারণা আমাদের কথা থেকে জানা যায় সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়ের অনুরোধে তিনি এই ছবিটি তৈরি করেন।
সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী রচিত একটি কাল্পনিক গল্প অবলম্বনে এই চলচিত্রটি নির্মিত হয়েছে।ছবিটি তৈরি নিয়ে চিন্তা ভাবনা ছিলো অনেক আগে থেকেই। সত্যজিৎ রায় ১৯৬৭ সালেই লিখে ফেলেন ছবিটির চিত্রনাট্য।যেহেতু ছবিটি তৈরির পরিকল্পনা ছিলো অনেক আগে থেকেই সেহেতু ছবিটি নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের প্রত্যাশাও ছিলো অনেক বেশি। তিনি চেয়েছিলেন গুপি গাইন বাঘা বাইন কালার ছবি হোক। তাতে বাজেট ছুঁয়েছিলো আকাশ সমান।ইতিমধ্যে সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন কান-বার্লিনের মতো বিখ্যাত চলচিত্র উৎসব গুলিতে সম্মান।কিন্তু তারপর কোনো প্রযোজক সত্যজিৎ রায়ের গুপি গাইন বাঘা বাইন করতে রাজি ছিলেন না। তার প্রধান কারন ছিলো অতিরিক্ত বাজেট আর শিশুদের জন্য তৈরি ছবি হওয়ার জন্য। কারন তখন তারা মনে করতেন শিশুদের জন্য তৈরি ছবি তেমন ব্যবসা সফল হবে না।
এরপর সত্যজিৎ রায় অনেকটায় নিরাশ হন এবং ছবিটি না করার সিন্ধান্ত নেন। কিন্তু সেই সময়ে এগিয়ে আসে পূর্ণিমা পিকচারের নেপাল দও এবং অসীম দও। তারপর বহুবাঁধা পেরিয়ে পূর্ণিমা ফিল্মের প্রযোজনায় মাত্র ছয় লক্ষ্য টাকায় সাদাকালো ভাবে নির্মিত হয় গুপি গাইন বাঘা বাইন।এই সিনেমায় গুপি গাইনের ভূমিকায় ছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায় এবংবাঘা বাইনের চরিত্রে রবি ঘোষ।সিনেমাটি মুক্তি পায় ৮ ই মে ১৯৬৯।এবং এই সিনেমাটি ছিলো সত্যজিৎ রায়ের মোস্ট কমারশিয়াল হিট ফিল্ম।
একটানা ৫১ সপ্তাহ ধরে সিনেমা হলে চলেছিল এই সিনেমাটি। যা সেই সময়ের একটা বড় রেকর্ড।সিনেমাটির এতো সাফল্যতার কারন হিসেবে বলা হয় মূলত ছোটদের জন্য নির্মিত হলেও গুপি গাইন বাঘা বাইন ছিলো সব বয়সীর দর্শকেরই উপভোগ্য।কিন্তু এই গুপি গাইন বাঘা বাইন কেবল মাত্র রূপকথার একটি গল্প নয়। ছোটদের উদ্দেশ্যে তৈরি এবং হাস্যরসে ভরা হলেও এই সিনেমাটির মধ্যে লুকিয়ে আছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের নানান রাজনৈতিক আর্থ সামাজিক ও অন্যান্য ইতিহাস। প্রথমেই আসি রাজনীতির দিকে। সিনেমায় দেখতে পাওয়া যায় হাল্লা যুদ্ধ ঘোষণা করে সুন্ডির বিপক্ষে।যা দর্শকে নিয়ে যায় ১৯৬৫ তে।ওই বছর পাকিস্থান যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারতের বিরুদ্ধে।যদি সেই সময়ের পাকিস্থানের অর্থনীতির দিকে তাকানো যায় তাহলে লক্ষ্য করা যাবে যে সে সময়ে পাকিস্থানের মানুষ এক দিকে খেতে পাচ্ছেন না অর্থাভাবের জন্য অন্যদিকে পাকিস্থানী সরকার আমেরিকার থেকে একের পর এক যুদ্ধ অস্ত্র কিনেছে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এখানে হাল্লা রিপ্রেজেন্ট করেছে সেই সময়ের পাকিস্থানকে।
আর সুন্ডি হচ্ছে ভারতবর্ষ যেখানে মানুষ খুব শান্তিতে আছে। তাদের যতেষ্ট খাবার আছে, ফল আছে ফুল আছে মাঠ ভরা ধান আছে।কিন্তু এখানে কথা বলার ক্ষমতা শুধু রাজারই আছে।প্রজারা আছে কিন্তু তাদের কথা বলার কোনো ক্ষমতা নেই। তৎকালীন ভারতবর্ষে যারা পলিটিক্যাল লিডার ছিলো তারাই দেশের জন্য সমস্ত সিন্ধান্ত গ্রহন করতো। এখানে সাধরণ জনগনের কথা বলার কোনো অধিকার ছিলো না।বা তাদের কোনো সুযোগ ও দেওয়া হতো না।এই ঘটনাটিই আমরা সুন্ডির ক্ষেত্রে দেখতে পাই।
দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছে মানে পুরো ওয়ার্ল্ডের একটা পলিটিকাল ব্যপার সেই জিনিসটাকে এরকম একটা রূপকথার মধ্যে লিখে সত্যজিৎ রায় কিভাবে গুপি গাইন বাঘা বাইন গল্পের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন সেটাই সবার কাছে প্রধান আকর্ষণের বিষয়।
এর পরেই আসা যাক সমাজ বাস্তবতার দিকে, ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো ভূতের দলের নাচ।প্রায় সারে ছয় মিনিট ধরে চলে ভূতের দলের নাচ।বাংলায় ভূতের যে চিরাচরিত্র ধারনা আমাদের আছে তা কতটা এরকম তার কুলোর মতো কান আর মুলোর মতো দাঁত। তবে উপেন্দ্রকিশোর এই বিষয়ে স্বচ্ছভাবে কিছু লিখে যাননি। এজন্য সত্যজিৎ রায় সৃষ্টি করলেন তার নিজের ম্যাজিক পর্দায়। আর তাইতো সত্যজিতের নির্মিত ভূতের রাজা বাঙালদের কাছে নস্টালজিয়ার অন্য এক নাম।এই দৃশ্যে ভূতের রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রসাদ মুখার্জী এবং ভূতের রাজার কন্ঠে আওয়াজ দিয়েছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
পর্দায় মোটামোটি চারটি শ্রেণী আমরা দেখতে পাই। এই বিভাজেনে প্রছন্ন আছে প্রাচীন ভারতের বর্ণাশ্রম এবং বহুধা বিভক্ত ভারতের ইতিহাস। ভূতের নাচ শুরু হয় প্রতিটি শ্রেণীর পরিচয় পর্বের মাধ্যমে। প্রথম শ্রেণী রাজা বাদশার রূপ নিয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণী চাষাভূষো, তৃতীয় শ্রেণী সাহেব ভূত, চতুর্থ শ্রেণী স্থলোবহুদের ভূত। নৃত্য দৃশ্যের কোরিগ্রফি করেছিলেন শম্ভুনাথ ভট্টাচার্য।এবংআট ডিরেকশনে ছিলেন বংশী চন্দ্র গুপ্ত।
নাচের দৃশ্যে ভূতের আকৃতি দেখানোর জন্য নেগেটিভ রিলের ব্যবহার এবং তার কম্পিত প্রক্ষেপন উল্লেখ্য।তবে ষাটের দশকে ভারতের প্রযুক্তি সিনেমায় ম্যাজিক্যাল ইলুয়েশনের অনুকুল ছিলো না।তাই এটি নিঃসন্দেহে এখন অবদ্ধি সিনেমা কোরিগ্রাফিতে করা একটা চমকপ্রদ কাজ।
এবার একটু দেখা যাক খেরোর খাতা। যেখানে সত্যজিৎ রায়ের পরিকল্পিত চলচিত্রের প্রতিটি ফেম্রের নকশা করা থাকতো। কোনো ক্ষেত্রে ওই নকশা গুলোই হয়ে দাঁড়াতো বেশ বড় আকারের স্কেচ। ভূতের নাচের স্কেচ গুলিও তার ব্যাতিক্রম নয়।
গুপি গাইন বাঘা বাইন সিনেমা জুরে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের কথা ও সুরে দশটা গান। যার মধ্যে ভুতের রাজা দিলো বর গানটায় কন্ঠ দিয়েছেন অভিনেতা তপেন চট্টোপধ্যায় এবং রবি ঘোষ।তপেন চট্টোপধ্যায়ের কন্ঠে বাকি গান গেয়েছেন অনুপ ঘোষাল। এবং রবি ঘোষের কন্ঠে স্বয়ং রবি ঘোষ। এই সিনেমায় অভিনেতা রবি ঘোষের পাশাপাশি আমরা পেয়েছি গায়ক রবি ঘোষকে।
সিনেমাটি মুক্তির পর শুধু ছোটদেরই নয় বরং বড়দেরও অসম্ভব পছন্দ হয়েছিলো। এবং সাথে জিতে নিয়েছিলো অসংখ্য পুরষ্কার। ছবিটি ১৬ তম জাতীয় পুরষ্কারে পেয়েছিলো বড় দুটি অ্যাওয়ার্ড। একটি সেরা পরিচালকের এবং অন্যটি সেরা ফিচার ফিল্মের। এছাড়াও ছবিটি বিদেশের মাটিতেও পেয়েছে আরো চারটি পুরষ্কার।অ্যাডিলেডে দা সিলভার ক্রস, টোকিওতে মেরিট অ্যাওয়ার্ড,মেলবান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা ছবির পুরস্কার এবংঅকল্রান্ড ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা পরিচালকের পুরস্কার।
ভারতীয় গণমাধ্যমের দেওয়া একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় বলেন গুপি গাইন বাঘা বাইন , হীরক রাজার দেশে, গুপি বাঘা ফিরে এলোর পর এবার খুব তারাতাড়িই তিনি ছবিটির চতুর্থ পাঠ তৈরির কাজ শুরু করতে চলেছেন।দর্শকের জন্য চতুর্থ পাঠে আসতে চলেছে আরো নতুন কিছু চমক।
গুগি গাইন ও বাঘা বাইন শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয় এটা আপারময় বাঙালিদের কাছে একটা নস্টালজিয়া। মানুষের মনে আজীবন গুপি, বাঘা অমর হয়ে থাকবে।
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা , মিডিয়া ও যোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি