অসুন্দরের মাঝেই ভালোবাসার গল্প ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’
- আবু রিফাত জাহান
বলা হয়ে থাকে, সুখ-দুঃখ নাকি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু এমন একটা সিনেমার কথা বলতে যাচ্ছি আমরা, যার মুদ্রার দুই পিঠে ঘুরে দেখার কোনো দরকার নাই। জীবনের সবচাইতে কঠিন বাস্তবতা আর প্রতিকূলতার মাঝেই কিভাবে ভালোবাসা আর মানবতার জয়গান করা যায়, তার চিত্রায়ণ করেছে ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ সিনেমাটিতে।
একজন সাদাসিধা মানুষের সুন্দর চোখে বিভীষিকাময় পৃথিবীও কতটা সুন্দর করে উপস্থাপন হয়, এবং মৃত্যুপুরী পৃথিবীতেও ভালোবাসার জয়গান করা যায়; সিনেমার মাঝে সেই চরম বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন সিনেমার নায়ক, পরিচালক ও গল্পকার রবার্টো বেনিনি।
সিনেমাটির প্রধান চরিত্র গুইডো(রবার্টো বেনিনি) জীবিকার তাগিদে ইতালি শহরে আসেন। ইচ্ছে ছিল বইয়ের দোকানে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি বেকারত্ব ঘুচানো। কিন্তু বিভিন্ন ঝামেলায় তা আর পেরে উঠা হয়নি তার, তাই চাচার হোটেলে ওয়েটারের কাজ করতে থাকেন তিনি। তবে তার আশেপাশের মানুষ তার যে কোনো পরিবেশের আচার-আচরণে কিছুটা বিস্মিত এবং প্রচুর প্রাণবন্ত হয়ে উঠে মুহুর্তে। কারণ গুইডো তো হার না মানা দলের লোক। মুখে হাসি আর কর্মচঞ্চলতায় মুখর করে রাখে চারপাশ৷
অবশ্য সেই কর্মচঞ্চলতার মাঝে অজস্র হাস্যরসাত্মক ঘটনা যে মিশে থাকে, তাই হয়তো অন্য দশজনের কাছে তা অস্বাভাবিক লাগে। কিন্তু গুইডো নিজের জীবন নিয়ে পরিতৃপ্তি আর কাজে স্বতঃস্ফূর্ততার কোনো অভাব নেই তা আপনি সিনেমার প্রথম ১০-১২ মিনিটের চিত্রেই বুঝে যাবেন।
এমন একটা ক্যারিশমাটিক চরিত্রের কাছে ভালোবাসায় ধরাশায়ী হয় ডোরা(নিকোলেটা ব্রাসচি, রবার্টো বেনিনির বাস্তব জীবনে পত্নী)। তৎকালীন সামাজিক প্রতিপত্তির কাছে গুইডো যতটা চাল-চুলোহীন ভ্যাগাবন্ড, ডোরা যেন ঠিক তার বিপরীত। সম্ভ্রান্ত ঘরের আদুরে মেয়ে, বিয়েও ঠিক হয়ে আছে একজন সিভিল সার্ভেন্টের সাথে।
কিন্তু বিধি বাম, গুইডোর প্রাণ সঞ্জীবনী দেখে প্রেমে পড়ে যায় ডোরা আর ততক্ষণে বেচারা গুইডো তো প্রেমের জলে ডুব খাচ্ছে। তাই সকল বাধা-বিপত্তির এই ভালোবাসার কাছে হার মেনে যায়; বিয়ে হয়ে যায় গুইডো আর ডোরার। আর ডোরার অনুরোধে স্ত্রী-সহ চলে যায় অনেক দূর।
সিনেমার এই পর্যায়ে খুবই চমৎকার দৃশ্যের অবতারণ ঘটে, যার জন্য পরিচালককে যে কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করলেও কম হবে। গুইডো আর ডোরা একটি ঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আর পরিচালক তাদের বিবাহ পরবর্তী ৫ বছর অতিক্রান্ত সময়কে বোঝানোর জন্য ওই দরজা দিয়েই তাদের ফুটফুটে ছেলে সন্তানসহ বের হওয়ার যে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করেছেন, তা রীতিমতো আপনাকে অবাক করে তুলবে।
আর এরকমই ছোট-খাটো সুখ-দুঃখের খুনসুঁটি গল্প নিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে সিনেমাটি। ক্রমেই সাংসারিক ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠতে থাকবে গুইডো। তার সন্তান যশোয়ার একের পর এক আজব ও কঠিন প্রশ্নের সহজ, সাবলীল ও বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর আপনাকে গুইডো চরিত্রটির প্রতি গভীর ভাবাবেগ তৈরি করবে।
সিনেমার দ্বিতীয় অংশে আপনি দেখতে পাবেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা, যেখানে ইহুদী বিদ্বেষী অসুন্দর পৃথিবীটাকে আপনার কাছে খুবই বেদনাদায়ক করে তুলবে। কিন্তু আগেই বলেছি, এই সিনেমা অসুন্দরের মাঝে ভালোবাসায় বাঁচতে শিখিয়েছে। তাই চোখের কোণে পানি জমে গেলেও সিনেমা স্ক্রিন থেকে আপনি চোখ সরাতে পারবেন না সেটা হলফ করে বলা যায়। গুইডোর স্ত্রী আর ছোট সন্তানসহ নাৎসী বাহিনীর কাছে কারারুদ্ধ হোন। কিন্তু ছেলে যশোয়ার কাছে তিনি কোনোভাবেই এই হিংসাত্মক, অমানবিক পৃথিবীর পরিচয়ে পরিচিত করবেন না।
তাই ছেলের সাথে বুদ্ধি করে বের করেন এক বিশেষ খেলা। সেই খেলায় নাৎসী বাহিনীর কাছ থেকে প্রতি পদে পদে টিকে থাকতে পারলে পাওয়া যাবে পয়েন্ট। আর এভাবে জিততে পারলে খেলা শেষে দেয়া হবে একটা সত্যিকারের ট্যাংক৷ অযাচিত অত্যাচার আর নির্যাতন সহ্য করেও হাসিমুখে ছেলের সামনে দাঁড়ানো আর রোমাঞ্চকর এই খেলায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের যে চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সে জন্য অস্কার তার প্রাপ্যই ছিল। জুরিবোর্ডও নিরাশ করেন নি তাকে। অপরদিকে ডোরাও আলাদা কারাগারে নির্মমতার স্বীকার হোন। প্রতি মুহুর্তে চোখের সামনে মানুষের হত্যা, অত্যাচার চোখ সয়ে যাবে আপনার, শুধু রয়ে যাবে বুকের মধ্যে হাহাকার।
ছেলে যশোয়া তার বাবার কাছে বার বার আবদার করতে থাকে, খেলা শেষ করার জন্য। হতাশ হয়ে যেতে থাকে সে। কিন্তু গুইডো তো সন্তানকে নিরাশা করে দিতে পারেন না। এই খেলায় নিরাশা মানে সন্তান হারিয়ে ফেলা, তা একজন বাবা কিভাবে হতে দেয়। তাই প্রতিদিনই কোনো না কোনো রোমাঞ্চকর নিয়মনীতি তৈরি করে ছেলে কে তিনি খেলায় মেতে রাখেন। এইতো সে বিজয়ের কাছাকাছি, তার কাঙ্ক্ষিত ট্যাংক তো চলে আসবে।
এমন স্বপ্ন যখন যশোয়ার কাছে সত্যি, নাৎসী বাহিনী যখন মানবতার কাছে ধরাশায়ী তখন জীবনের কাছে হেরে যায় গুইডো আর জিতে যায় তার পিতৃত্ব। পরিবারকে রক্ষা করতে একজন গুইডোর প্রাণ যায় ইহুদি বিদ্বেষী নাৎসী বাহিনীর কাছে। আর এখানেই জীবনের সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন পরিচালক। জীবন তো তখনই সুন্দর যখন জিতে যায় ভালোবাসা আর হেরে যায় নির্মমতা, হিংসা, বিদ্বেষ।
চমৎকার এই ইটালিয়ান সিনেমাটি ১৯৯৭ সালে প্রেক্ষাগৃহে আসার মুক্তির পর তাক লাগিয়ে পুরো সিনেমাপাড়াকে। সিনেমাটি ৭১তম একাডেমী এ্যাওয়ার্ডে (অস্কার) বেস্ট ফরেন ফিল্ম, বেস্ট এক্টর এবং বেস্ট মিউজিকে পুরস্কার পায়, তাছাড়া অস্কারে আরো চারটি ক্যাটাগরিতে সিনেমাটি নমিনেটেড ছিল। কৌতুক, ড্রামা, রোমান্সে ঘিরে সিনেমাটি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ১০টি সিনেমার মধ্যে বিবেচিত বলে অধিকাংশ সিনেমা সমালোচকরা মতামত দিয়ে থাকেন। করবেন না কেন, যেখানে জীবনের বড় সৌন্দর্য ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সবচাইতে প্রতিকূল পরিবেশের মাঝেও, সেই সিনেমা উপভোগের পরেই তো বলা যায় ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’।
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি