একজন হাবিবুল্লাহ পাঠান ও উয়ারী- বটেশ্বর
- মোঃ ইমন আল রশিদ উৎস
হাবিবুল্লাহ পাঠান নামটি যখন বলা হবে তখন হয়তো অনেকের কাছেই অপরিচিত ঠেকবে। তবে যদি বলি উয়ারী বটেশ্বর তবে চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান যা কিনা আমরা ইতিমধ্যে বই পুস্তকের মাধ্যমে অবগত হয়েছি। কিন্তু আমরা কি জানি এই প্রাগৈতিহাসিক স্থানের আবিষ্কার হয় কার হাত ধরে? বলুন তো কার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো দূর্গনগরীর ধ্বংসাবশেষ, তিনহাজার বছর আগের লৌহ কুঠার, চার-পাঁচহাজার বছর আগের নব্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন, তিন-চার হাজার বছর আগের তাম্র প্রস্তর যুগের ব্রোঞ্জ বলয়, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত পোড়া মাটির গোলক, নানা বর্ণেরঙে পাথরের পুতিঁ ও বিভিন্ন ধরণের রৌপ্যমুদ্রা আজও যত্ন সহকারে ‘বটেশ্বর প্রত্ন সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগার’ নামের ব্যক্তিগত জাদঘুরে সুসজ্জিত করে রাখা আছে?
এই সেই হাবিবুল্লাহ পাঠান। একজন বাংলাদেশি প্রত্ন সংগ্রাহক ও গবেষক। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০০৯ সালে তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করা হয় প্রত্নতত্ত্বে বিশেষ অবদানের জন্য। ফোকলোর গবেষণায় অবদানের জন্য ২০২১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। মূলত তিনি তার পিতা হানিফ পাঠান, যিনি ছিলেন উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার পথপ্রদর্শক, তার হাত ধরেই প্রত্ন সংগ্রাহক ও গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠেন। তার বাবা ও ছিলেন একজন লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষক। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি পিতার সাথে উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নস্থলের গবেষণায় সাহায্য করা শুরু করেন।এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালে প্রথম এ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ করা হয় এবং ২০০০ সালে উয়ারী বটেশ্বর খননেন কাজ শুরু হয়।
সৌভাগ্যক্রমে এরকম একজন গুনী ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার বলব না এইটা ছিল জ্ঞানের ভান্ডারের সাথে একটি আনন্দদায়ক খোশগল্প। উয়ারী-বটেশ্বর আবিষ্কারের গল্পেরমধ্যে হঠাৎ-ই বলে উঠলেন একটা গান ধরো নচেৎ আলোচনাটা জমছে না। এই বলে তিনি নিজেই একটি লোকসংগীত গাইতে শুরু করলেন। এতক্ষণ আলোচনায় দুষ্প্রাপ্য বই, ঐতিহাসিক সাময়িকী ও বিভিন্ন স্মারকের কথা শুনে উনার জ্ঞানের গভীরতাটা বুঝতে পারছিলাম আর এখন লোকসংগীতের মধ্য দিয়ে একজন সংস্কৃতিমনা ও মাটির মানষেুর সাথে মাটির টান অনভবু করতে শুরু করলাম।
উনি এতটাই আবিষ্কারের নেশায় মত্ত ছিলেন যে একসময় স্থানীয় শিশু-কিশোরদেরকে প্রাচীন প্রত্নসামগ্রী কুড়িয়ে দেয়ার বিনিময়ে সামান্য কিছু টাকা-পয়সা দিতে লাগলেন আর সংগ্রহ করতে লাগলেন উয়ারী বটেশ্বর এলাকার অনাবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
উনার একটা ইচ্ছে ছিল যে উনার গর্বের ও পরিশ্রমের জায়গাকে কেন্দ্র করে একটি গবেষণা জাদুঘর তৈরি হবে।
তারই ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র “ঐতিহ্য অন্বেষণ”- এর উদ্যোগে ওনার বাড়ির পাশে উয়ারী বটেশ্বর দূর্গনগর উন্মুক্ত জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়েছে। এ ধরনের প্রত্ন জাদুঘর বাংলাদেশে এটিই
প্রথম। উনার সাথে যতই কথা বলছিলাম ততই জানার আগ্রহ বাড়তে শুরু করছিল। কিন্তু বিদায়ের ঘন্টাও সেদিকে বেজে গেছে। ততক্ষণে উনার সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উনার মন সায় দিলেও ৮৩ বছরের শরীরটা আর কুলিয়ে উঠতে পারছিল না।বিদায় নেওয়ার সময় ওনার লিখিত “উয়ারী-বটেশ্বর: শেকড়ের সন্ধানে” নামক গবেষণাগ্রন্থ বইটি উপহার হিসেবে আমার হাতে তুলে দেন। এই বইটি ২০১৩ সালে প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার লাভ করে।