বার্সেলোনার আদ্যপ্রান্ত
- সব্যসাচী দাস
“জোয়ান গাম্পার” নামটা চেনা চেনা লাগছে? নামটা অনেকের অচেনা মনে হতেই পারে কারন কাহিনীটা তো আর আজকের না সে অনেক দিন আগের কথা এক শতাব্দী পূর্বে ১৮৯৯ সালের ২২শে অক্টোবর সে ঘোষনা দেন লস দেপোর্টেস” পত্রিকায় তার ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্টা নিয়ে তখন তিনি হয়তো জানতেন না তিনি কি তৈরি করছেন অথবা হয়তো তিনি তার স্বপ্নে কোন আদেশ পেয়ে বুঝেছিলেন ভবিষ্যতে তার বানানো ফুটবল ক্লাবটি বিশ্বকে মাতিয়ে তুলবে। এরপরেই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ২৯শে নভেম্বর তৈরি হয় বর্তমান বিশ্বের ফুটবল প্রেমিদের মনে জায়গা করে নেয়া দল ‘ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা”।
৯ দিন পর দলটি অফিশিয়ালি প্রথমবারের মত মাঠে নামে ইংলিশ কলোনির বিপক্ষে না তখন ছিলো না ন্যু ক্যাম্পের মত মাঠ গায়ে ছিল না জার্সি যেকোন মতে খেলা শেষ করলো বার্সেলোনা। ১৯০২ সালে বার্সেলোনার প্রথম অর্জন কোপা মাকায় শিরোপা অই একই বছর তারা কোপা দেলরে তে এতলেটিকো বিলবাও এর কাছে ২-১ এ হেরে রানার্স আপ হয়। ১৯০৯ সালে বার্সেলোনা তাদের প্রথম হোম স্টেডিয়াম পায় “কাম্প দে লা ইন্ড্রাস্তিয়া”।১৯২৮ সালে বার্সেলোনা প্রথম কোপা দেল রে জয়ী হয় কিন্তু এরপরই আসে বার্সেলোনায় একটি অন্ধকার দিন ১৯৩০ সালের ৩০শে জুলাই বার্সেলোনাকে ১১ টি কাতালো, ৬টি কোপা দেল রে, এবং ৪ টি পাইরেনিস শিরোপা জিতানো প্রেসিডেন্ট এবং বার্সেলোনার প্রতিষ্ঠাতা জোয়ান গাম্পার অর্থনৈতিক অবসাদের জন্য আত্মহত্যা করেন। ১৯৫৯ সাল বার্সেলোনার প্রথম ডাবল জয়ী বছর যদিও ১৯৬০ সালে আবার ডাবল জয়ী হয় তারা।
এরপর পেপ গার্দিওয়ালার অধীনে রিয়াল মাদ্রিদকে ৬-২ ব্যাবধানে হারিয়ে লিগ শিরোপা জিতে নেয় বার্সেলোনা, এর কিছুদিন আগে তারা তাদের প্রথম কোপা দেল রের ফাইনাল যাদের সাথে হেরেছিলো সেই এতলেটিকো বিলবাও কে ৪-১ ব্যাবধানে হারিয়ে কোপা দেলরে জয়ী হয় বার্সেলোনা, ঠিক তারপরেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কে ২-০ গোলে হারিয়ে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা তাদের প্রথম ট্রেবল জিতে নেয়। এটি স্পেনিশ কোন ক্লাবের প্রথম ট্রেবল জয় ছিলো। বার্সেলোনার ইতিহাসে পেপ গার্দিওয়ালা ছিলেন সবথেকে বেশি শিরোপা জয়ী ম্যানেজার।
এরপর এই দলের পরিচালনায় আসেন লুইস এনরিকে যার অধীনেও ২০১৫ সালের ৬ জুন চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের মাধ্যমে বার্সেলোনা তাদের দ্বিতীয় ট্রেবল জয়ী হয়। এবং বার্সেলোনা ইউরোপের প্রথম দল যারা দুইবার ট্রেবল জয়ী হয়েছে। কাতালিয়ান ক্লাব বার্সেলোনার কোন নির্দিষ্ট মালিকানা নেই। এই ক্লাবের সমর্থকরাই ক্লাবের মালিক। ক্লাবটির সদস্যদের বলা হয় সোসীয়। ক্লাবটির মুলমন্ত্র Mes Ques Un Club যার অর্থ এটি একটি ক্লাবের থেকেও বেশি কিছু। বার্সেলোনা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ সমর্থকধারী ফুটবল ক্লাব এবং এটি বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী দল। ক্লাবটিতে হাত রেখেছেন অনেক ফুটবল লেজেন্ডরা এদের মধ্যে অন্যতম মারিয়ানো মার্টিন,চিজার রোদ্রিগেজ, মারিয়া গনজালভো, লুইস সুয়ারেজ,জোহান ক্রুইফ, ডিয়েগো ম্যারাডোনা,রিষ্টো স্টোইচকভ,রিভালদো, রোনালদো, রোনালদিনহো, স্যামুয়েল ইতো এবং কার্লস পুয়েল অন্যতম।
এইতো ছিলো ফুটবল নিয়ে বার্সেলোনার স্বর্নালী ইতিহাস এবার একটু স্পেনের রাজনৈতিক খাতে, ও জাতি হিসেবে কাতালোনিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় বার্সেলোনার অবদান নিয়ে কথা বলা যাক।
যেমনটি আগেই বলেছি এফসি বার্সেলোনার মূল লক্ষ্য “মেস কিউ আন ক্লাব” বা “একটি ক্লাবের চেয়ে বেশি” এটি শুধুমাত্র একটি স্লোগান নয় বরং এর পিছনে রয়েছে স্পেন ও কাতালানদের অন্তর্বর্তী কলহের ইতিহাস।
এই স্লোগানটি আমাদের নিয়ে যায় ১৮৯৯ সালে কাতালান ক্লাবের প্রতিষ্ঠার সময়কালে। আজও, এই সদস্যরা বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা নিয়ন্ত্রিত ক্লাবগুলির মধ্যে একটির অংশ হতে একটি বার্ষিক ফি প্রদান করে।
প্রথম থেকেই বার্সেলোনা কাতালান পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু এবং পাশাপাশি গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতটা যে ১৯২৫ সালে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী প্রিমো ডি রিভেরা গাম্পার এবং বার্সাকে কাতালান জাতীয়তাবাদের প্রচারের জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় ন্যু ক্যাম্প শহরের এমন কয়েকটি জায়গার মধ্যে একটি হয়ে ওঠে যেখানে লোকে কাতালান ভাষায় প্রকাশ্যে কথা বলতে পারে।
সুতরাং এটি আশ্চর্যজনক যে সাম্প্রতিক সময়ে এফসি বার্সেলোনা এই অঞ্চলের স্বাধীনতার ভোটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অক্টোবর ১,২০১৭ সাল রবিবার, ভোটের দিন – যা স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার অবৈধ ঘোষণা করেছিল – শহরজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় বার্সা লাস পালমাসের বিরুদ্ধে লিগের ম্যাচ পিছিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। যখন এর অনুরোধ অস্বীকার করা হয়েছিল, ক্লাবটি শেষ মুহুর্তের একটি বিবৃতি জারি করেছিল যা নাগরিকদের ভোটদান বন্ধ করার চেষ্টার নিন্দা করেছিল এবং বলেছিল যে খেলাটি এগিয়ে যাবে, তবে বন্ধ দরজার পিছনে।
এই ম্যাচটি যদিও অর্থ দিয়ে ভরা ছিল। কেউ কেউ টেলিভিশন সংস্থাগুলির কাছে বিক্রি করার জন্য, রাজনৈতিক নীতির চেয়ে সম্প্রচার চুক্তি থেকে অর্থোপার্জন করার জন্য এই ক্লাবটির সমালোচনা করেছিলেন। অন্যরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে লা লিগা সভাপতি জাভিয়ের তেবাস, আজীবন রিয়াল মাদ্রিদের ভক্ত বার্সার উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। তিনি লাস পলমাস দলকে তাদের শার্টে বোনা একটি বিশেষ স্পেনীয় পতাকা নিয়ে খেলার অনুমতিও দিয়েছিলেন।
খেলা চলাকালীন মাঠে অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন বার্সার তাবিজ ডিফেন্ডার জেরার্ড পিকে, যিনি প্রকাশ্যে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার ভোটের পক্ষে তার সমর্থনের দাবী করেছেন। অন্যান্য স্প্যানিশ ভক্তদের দ্বারা সমৃদ্ধ পিকে এমনকি দেশের জাতীয় দলের হয়ে খেলা ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।
কালে কালে কাতালানদের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা ঘটে আসছে, কেউ কেউ এমনও পরামর্শ দিয়েছেন যে বার্সা ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগে যোগ দিতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে, এটি হতে পারে বার্সেলোনা ক্লাবের জন্য একটি স্বর্গীয় সুযোগ। তবে এটি ঘটারপক্ষে সম্ভাবনা শূন্যর খাতায়। অন্তত এমন পদক্ষেপের সম্ভাব্য জটিলতার কারণে নয়। অন্যান্য বিকল্প হতে পারতো স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বী এস্পানিয়ল, গিরোনা এবং তারাগোনা দের নিয়ে একটি ছোট্ট কাতালোনিয়া লিগ তবে এটি কল্পনা করাও খুব কঠিন এবং এর থেকে বড় আয় উপার্জনের জন্য লড়াই করা অসম্ভব।
এ জাতীয় বিতর্ক অকাল বোধ হতে পারে। তবে ক্লাবটিকে কীভাবে তার বাণিজ্যিক পাশাপাশি রাজনৈতিক অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সেটা বেশ নান্দনিকও বটে। গ্যাম্পার ঠিকই বলেছিল, এফসি বার্সেলোনা শুধু একটি ফুটবল ক্লাব নয় বরং এর থেকেও বেশি কিছু। ইতিহাসকে সাক্ষ্য রেখে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা এই উক্তির সত্যতা ধরে রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও রেখে যাবে। বার্সেলোনা একটি ফুটবল ইতিহাসে বাধাই করে রাখার জন্য ক্লাব তো বটেই এর সাথে এটি একটি জাতিকে স্বাধীনতা দেয়ার আন্দোলনে মোটা কালির দাগ দেয়া এবং শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য একটি ক্লাব হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করেছে, করছে,করবে।
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা, মিডিয়া ও যোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি