বাংলার নারী জাগরণের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা
- জাকিয়া সুলতানা চন্দ্র
নারী সমাজ আজ মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে শিখেছে, ভয়কে জয় করে এগিয়ে যাচ্ছে সাফল্যের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যদি পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব একজন বেগম রোকেয়া, একজন বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, একজন সুফিয়া কামালের কাজ কিন্তু সহজ ছিল না। নারী সমাজের মুক্তি ও নারীজাগরণের লক্ষ্যে কলম ধরেছিলেন তারা। নারীবিরোধী অচলায়তনের ভিত তখন খুবই শক্ত। বলার অপেক্ষা রাখেনা, বাঙালি সমাজে শোষিত বঞ্চিত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও নিগৃহীত হলো নারীসমাজ। কারণ, রক্ষণশীল ধর্মীয় সমাজ কখনই নারীদের এগিয়ে যেতে দেয়নি। কিন্তু পৃথিবীর সকল কাজেই নারীর অংশীদারিত্ব রয়েছে। নিজ নিজ জীবনে র্ধম-বর্ণের ঊর্ধ্বে গিয়ে নারীত্বের মহিমা নিয়ে ও শিক্ষাকে আশ্রয় করে অনেকেই হয়ে উঠেছেন মুক্ত জীবন সন্ধানী।
বেগম রোকেয়া
তার জন্ম ৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০। বাঙালী নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারীর স্বাধীনতার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। সমাজের অন্ধকার পথকে পেছনে ফেলে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে তিনি লিখেছেন অসংখ্য লেখা। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ দূর করে একই সঙ্গে সমাজ গড়ার প্রেরণা হিসেবে যুগে যুগে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন এ মহীয়সী নারী। তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ ও মতিচূর উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকান্ডে নারীদের এগিয়ে নিতে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ও আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া ইন্তেকাল করেন।
বেগম সুফিয়া কামাল
বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব সুফিয়া কামাল। তিনি কবি হলেও সবার কাছে আরোও একটি পরিচয় আছে- জননী সাহসিকতা। যুগে যুগে যারা নারী জাতির অগ্ৰগতির জন্য অবদান রেখেছেন তার মধ্যে সুফিয়া কামাল অন্যতম। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ও নারীদেরও অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শিশুদের ‘কচিকাঁচার মেলা’। এছাড়াও তিনি ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন ও গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তাকেই প্রথম পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম
তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। মুক্তিযুদ্ধে তার ছেলে রুমী শহীদ হন। যুদ্ধের পর তিনি স্বীকৃতি পান সব মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে। এজন্য তাকে শহীদ জননী হিসেবে ভূষিত করা হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকারদের নির্মূলে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থের লেখক । ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করা হলে তিনি পরের বছরই ১০১ সদস্যের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেন। এছাড়াও গণআদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ও দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য এ রোগে ভুগে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
এই মহীয়সী নারী বিশ্বের কাছে পরিচিত ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী নারী হিসেবে। ছদ্মনাম ফুলতার আর ডাকনাম রানী। প্রীতিলতা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সূর্যসেনের নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেন। এই মহান নারী ১৫ জনের একটি দলও পরিচালনা করেন। কিন্তু পুলিশ প্রীতিলতার দলটিকে আটক করে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ানের ক্লাব দখলের সময়। পুলিশের কাছে ধরা দেয়ার চেয়ে বিপ্লবের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করাটাই মহৎ ছিল তার কাছে। তাই ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরে ঘটনাস্থলে পটাশিয়াম সায়ানাইড বিষ খেয়ে আত্মাহুতি দেন প্রীতিলতা। এমন বিপ্লবী নারীর আত্মদান ইতিহাসে বিরল।
ডাক্তার জোহরা বেগম কাজী
তিনি প্রথম বাঙালি মুসলিম মহিলা চিকিৎসক ছিলেন। ১৯৩৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করার পর জোহরা কাজী কর্মজীবনে প্রবেশ করেন৷ ঢামেক হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় অবসর সময়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (ঢাকা)-এ সাম্মানিক কর্নেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান ও সাম্মানিক অধ্যাপিকা ছিলেন৷ ১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেবার পর বেশ কিছু বছর হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে পরামর্শক (কনসালট্যান্ট) হিসাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন৷ পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে সাম্মানিক অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন৷ ঢাকা মেডিকেলে দায়িত্ব পালন করার সময় নারী রোগীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত কুসংস্কার তাঁকে আহত করে। তিনি তাদের সাথে সরাসরি কথা বলে তাদের ভুল ধারণা দূর করার চেষ্টা করতেন। তাঁর কারণে পরবর্তীতে চিকিৎসা শাস্ত্রে এদেশে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়।
অদম্য সাহসী আলোকচিত্রী সাইদা খানম
দেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন সাইদা খানম। প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। দুটো জাপানি পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার তোলা আলোকচিত্র মুদ্রিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটো মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়ার পথেই সাইদা খানম তার ক্যামেরায় ধারণ করেন সময় আর মানুষের মুখ, ইতিহাস আর জীবনের আখ্যান। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণের অনবদ্য ছবি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে।
নারী সাংবাদিকতায় পথপ্রদর্শক নূরজাহান বেগম
তার হাত ধরেই খবরের কাগজ সম্পাদনায় পা রাখেন বাংলাদেশের নারীরা। ১৯৬৯ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্রের সম্মাননা লাভ করেন। তিনি পত্রিকা শিল্পে তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা লাভ করেন।
নীলিমা ইব্রাহিম
বাংলা একাডেমির প্রথম নারী মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০০০ সালে একুশে পদক লাভ করেন । সবচেয়ে আলোচিত বই ‘আমি বীরঙ্গনা বলছি’।
নভেরা আহমদ
বাংলাদেশের প্রথম নারী ভাষ্কর নভেরা। ১৯৯৭ সালে ভাষ্কর্য শিল্পে অবদানের জন্য তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় ।
বাংলার মহীয়সী নারীরা দেশ তথা সমাজের প্রতিটি নারীকে আলোক বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন তেজস্বী, বুদ্ধিদীপ্ত, সংগ্রামী, মহীয়সীরা নারী মুক্তির পথে আলোকবর্তিকা। শিক্ষাহীন, আলোহীন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অন্ধকারের শেকল ভেঙেছেন বাংলার মহীয়সী নারীরা। এক এক জন হয়ে উঠেছেন খোলা আকাশের মহিমান্বিত তেজস্বী নারী স্বাধীনতার প্রতীক। তাঁদের বহুমুখী প্রতিভা তাদেরকে করেছে মহীয়সী, বাংলার ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। বিনম্র শ্রদ্ধার সহিত তাঁরা চিরস্মরণীয়।
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি