আমরা কি এক নতুন পৃথিবীর উত্থান দেখছি?
- খুলাউদ আল ওমিয়ান
বিশ্ব ব্যবস্থার অনেক দুর্বলতাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস অথবা কোভিড-১৯। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সম্মিলিত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এই ভাইরাস আমাদেরকে ঘরবন্দি হতে বাধ্য করেছে। কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভাইরাস কি পৃথিবীর পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেবে? আমরা কী এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার সন্ধান পেতে যাচ্ছি কিংবা এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি যা মোড় ঘুরে দেবে ইতিহাসের? অথবা যে অতীতকে একদা পেছনে ফেলে এসেছি সেই অতীতের পৃথিবীতে আবার ফিরে যাব? নিশ্চয় সে রকম কিছু হবে না। তবে এটাও সত্য, কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। সবকিছু বদলে যাবে।
আমি অর্থনীতির ধ্বসে পড়া কিংবা বৈশ্বিক মন্দা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি না। এটা তো বোঝাই যাচ্ছে যে এই মহামারি ২০০৮ সালের মতো বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আঘাত করবে। এর পরিবর্তে আমি যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই সেটি হচ্ছে, আমরা সম্ভবত বিশ্ব ব্যবস্থার পুণর্গঠন প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি। সেই পুণর্গঠনের মধ্যে যে বিষয়গুলো থাকবে বলে আমার পূর্বানুমান, সেগুলো হচ্ছে:
১. বৈশ্বিক পরাশক্তির ভারসাম্য
বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর ক্ষমতার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য আসবে এবং ক্ষতমার নিক্তি অনেকটাই চীনের দিকে ঝুঁকে পড়বে। অপরদিকে এশিয়ার দেশগুলোও নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করবে।
২. স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থা
পণ্য উৎপাদন অবকাঠামোতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চলে আসবে। এই ব্যবস্থা পৃথিবীর জ্বালানীকে সংরক্ষণ করবে। শুধু তাই নয়, উৎপাদন ব্যয় কমাবে এবং পণ্যের গুণগত মান বাড়বে। মানুষের কর্মঘণ্টা অনেক কমে আসবে, ফলে তারা নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে মনোযোগ দিতে পারবে।
৩. প্রযুক্তি নির্ভরশীলতা
মানুষের প্রযুক্তি নির্ভরশীলতা বহুগুণে বেড়ে যাবে। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থায় গ্রাহকরা অভ্যস্ত হয়ে যাবে এবং এতে তাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণে বিরাট পরিবর্তন আসবে। তারা সেই আগের চিরাচরিত লেনদেন ব্যবস্থা প্রায় ভুলেই যাবে। আমরা ঘরে বসে কাজ করা শিখে যাব। সন্দেহ নেই, আমরা এমন এক ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছি যেখানে থাকবে না ইট-কাঠ-যন্ত্রপাতির বিশাল বিশাল অফিস।
৪. হ্রাস পাবে ব্যবসায়িক ভ্রমন
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে যেসব ভ্রমন করতে হয় সেসব ভ্রমনের পরিমাণ ভীষণভাবে কমে যাবে। কারণ প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক আলাপ আলোচনা, মিটিং—সব কিছুই হবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। মানুষ উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে পড়বে। যদি একান্তই বিদেশ ভ্রমনের প্রয়োজন হয়, তখন ব্যবসায়ীরা ফার্স্টক্লাস বিমানের পরিবর্তে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ ব্যবহারকেই প্রাধান্য দেবে।
৫. ই-সার্ভিস ব্যবস্থা
সরকারের যাবতীয় সেবা চলে আসবে ই-সার্ভিস ব্যবস্থার আওতায়। সকল ধরনের নাগরিকসেবা যেমন আইনি সুবিধা, অভিবাসন সংক্রান্ত সেবা, পাসপোর্ট সার্ভিস, মন্ত্রণালয়ের সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি সবকিছুই ই-সার্ভিসের মাধ্যমে গ্রহণ করবে রাষ্ট্রের জনগণ। সরকার ই-সার্ভিসিং চালু করতে বাধ্য হবে।
৬. স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়বে
সরকার তো বটেই, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্যখাতে তাদের বাজেট ও বিনিয়োগ বাড়াবে। করোনা অন্তত পৃথিবীর নেতাদেরকে এই বার্তা ভালোভাবেই দিতে পেরেছে যে, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়ানোর বিকল্প নেই। এই সময় প্রযুক্তির নানা ধরনের নতুন নতুন উদ্ভাবনও হবে স্বাস্থ্যখাতকে কেন্দ্র করে।
৭. মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি বিশ্বস্ততা বাড়বে
শক্তহাতে করোনা মহামারি মোকাবেলা করার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি মানুষের বিশ্বস্ততা বাড়বে। বিশ্বস্ততা বাড়বে বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও। তারা সহজেই সহযোগিতার হাত বাড়াবে। ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাংক বড় অংকের ছাড় দিয়ে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ অর্থঋণ দিয়েছে যা ইতিপূর্বে দেয়নি।
৮. সামাজিক পরিবর্তন
সমাজের বুকে এমন এক ধরনের পরিবর্তন আসবে যে পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দিতে আমরা আগে খুবই ব্যতিব্যস্ত ছিলাম। পরিবর্তনটা হচ্ছে সহমর্মীতা। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহমর্মী হয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে। কোটিপতিরা মানুষের জীবন বাঁচাতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অনুদান দিতে শুরু করেছে। তারা মানবিক সহায়তা দিতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন।
৯. পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন
এই মহামারি পরিবেশ ও প্রকৃতি জগতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। নাসা এবং ইএসএ লক্ষ্য করেছে যে মার্চ মাসে চীন ও ইতালীর বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ছিল উল্লেখযোগ্য হারে কম। অপরদিকে, ওসোর বিশ্বব্যাপী জিডিপি পূর্বাভাস ব্যবহার করে ওসলোর আন্তর্জাতিক জলবায়ু গবেষণা কেন্দ্র এই বলে পূর্বাভাষ দিয়েছে যে, ২০২০ সালে সারা পৃথিবীতেই কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ১.২% হ্রাস পাবে।
১০. বদলে যাবে শিক্ষা ব্যবস্থা
এই মহামারির পর শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে। ইতিমধ্যে আনেকাংশেই বদলে গেছে। বিশ্বের ১৮৮ দেশের স্কুল এখন বন্ধ রয়েছে। ইউনেস্কো বলছে, এ অবস্থায় হোম-স্কুলিং প্রোগ্রাম (ঘরে বসেই পড়ালেখার পদ্ধতি) চালু করা ছাড়া উপায় নেই। এতে করে মা বাবারাও তাদের সন্তানের দক্ষতা ও মেধা বিকাশে সাহায্য করতে পারছেন। এই দূরশিক্ষণ পদ্ধতি শিক্ষার ক্ষেত্রে এক ধরনের সমতাও নিয়ে এসেছে।
এই মহামারি, এই মহা দুর্যোগের দিন একদিন শেষ হবে। সেদিন আমরা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখব, সারা পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি বদলে গেছে। বদলে গেছে প্রযুক্তির আরও অনেক কিছু। সেই পরিবর্তনগুলো নিশ্চয় ইতিবাচক হবে।
সূত্র: ফোর্বস
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম