কুঁড়েঘরের প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা !
ইফতেখার ইফতি: কোন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদ ‘প্রেসিডেন্ট’ বলতেই চোখে ভেসে ওঠে আভিজাত্য, নিরাপত্তা আর প্রোটোকলে ঢাকা একজন সুরক্ষিত মানুষ। আলাদা গার্ড রেজিমেন্ট, প্রাসাদতুল্য বিলাসবহুল আবাসন – এমনটাই সাধারণত সকল রাষ্ট্রপতিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
শহরতলির প্রান্তে চাষীজমি ঘেরা টিনের কুড়েঘরে বসবাস করা একজন রাষ্ট্রপতির কথা যেন কল্পনাতেও আসতে চায় না। যেখানে সশস্ত্র দেহরক্ষীর ঝাঁক নয়, স্বাগত জানায় দেশি কুকুর আর মুরগির পাল। চোখ ধাঁধানো লিম্যুজিন বা বিলাসবহুল অন্য কোনও গাড়ি নয়, পড়ে থাকে ২৫ বছরের পুরনো ভাঙাচোরা ভক্সওয়াগন।
এমন অনাড়ম্বর রাষ্ট্রপতি আছেন ল্যাটিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়েতে। নাম হোসে মুজিকা। দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও নিজের জীবনযাপনের ধারা বদলাতে রাজি হননি তিনি। সেই কারণেই বিলাসবহুলতা ছেড়ে নিজের পুরনো বাড়ি, গাড়ি, খামার নিয়েই দিব্যি আছেন। দেশবাসী তাকে আদর করে ডাকেন ‘এল পেপে’।
মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোয় চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল তাকে। স্থানীয় এক বেকারির ডেলিভারি বয় হিসেবে ওই বয়সেই রোজগার শুরু করতে হয় তাকে। এছাড়া বাড়ির পেছনে বয়ে যাওয়া খাঁড়ি থেকে অ্যারাম লিলি ফুল তুলে বিক্রি করেও পরিবারের খরচ জোগান তিনি।
বেতনের ৯০ শতাংশ তিনি ব্যয় করেন বিভিন্ন জনহিতকর কাজে। তার সমর্থকদের মতে, এল পেপে মুখে যা বলেন কাজেও তা করে দেখান। অবশ্য তার অনেক সমালোচকও রয়েছে। তাদের মতে মুজিকার এসব কাজ লোক দেখানো। আসলে তিনি এক পাগলাটে ও বাতিকগ্রস্ত বুড়ো – যিনি বন্দুক ও বিপ্লব দুটোই সরিয়ে রেখেছেন।
নিন্দুকের কথা কখনও আমলে নেন না তিনি। স্পষ্টবাদী হিসেবে বরাবরই বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন। ক্ষমতায় এসে একদিকে যেমন দেশে গাঁজার চাষ ও বিপণনকে বৈধতা দিয়েছেন, তেমনই গর্ভপাত এবং সমকামী বিবাহকেও আইনি অনুমোদন দিয়েছেন। আবার এই মুজিকাই জাতিসংঘে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘বিপুল অর্থ ব্যয়ে আয়োজিত বৈঠকে যাওয়া বন্ধ করুন। ওখানে কাজের কাজ কিছুই হয় না।’
তরুণ বয়সে চরমপন্থী বাম গেরিলা নেতা হিসেবে উরুগুয়েতে ত্রাস ছড়িয়েছিলেন মুজিকা। মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোয় চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল তাকে। স্থানীয় এক বেকারির ডেলিভারি বয় হিসেবে ওই বয়সেই রোজগার শুরু করতে হয় তাকে। এছাড়া বাড়ির পেছনে বয়ে যাওয়া খাঁড়ি থেকে অ্যারাম লিলি ফুল তুলে বিক্রি করেও পরিবারের খরচ জোগান তিনি।
যুবক বয়সে জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা এনরিকে এরোর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু স্বাধীন কিউবায় চে গুয়েভারার সংস্পর্শে আসার পর তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার বদল ঘটে। পঞ্চাশের দশকের শেষে তীব্র মুদ্রাস্ফীতি ও রুগ্ন অর্থনীতির চাপে মহাসঙ্কট সৃষ্টি হয় উরুগুয়েতে। এই সময় চে’র ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন মুজিকা ও তার সঙ্গীরা। শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরুর কিংবদন্তী বিপ্লবী চরিত্র দ্বিতীয় টুপাক আমারুর নামানুসারে তাদের হাতেই জন্ম নেয় গেরিলা বাহিনী ‘টুপামারো’। অত্যাচারীর নিধন ও দরিদ্রের পালন নীতিতে বিশ্বাসী টুপামারোদের জনপ্রিয়তা উরুগুয়ের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজে বাড়তে থাকে হু হু করে। ব্যাংক লুট করে সমাজের বিত্তশালীদের অবৈধ অর্থসঞ্চয় দরিদ্রদের উন্নয়নে ব্যয়, ধনী ব্যবসায়ীকে হত্যা করে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, দামী ক্যাসিনো দখল করে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের টাকা পাঠানো ইত্যাদি করে হয়ে উঠেছিলেন গরীবের রাজা রবিনহুড।
কিন্তু ক্রমে দলীয় বিশৃঙ্খলার কারণে গতি হারায় বিপ্লব। ভাঙতে শুরু করে বিপ্লবীদের দলীয় সংহতি। একের পর এক অপহরণ ও ঠাণ্ডা মাথায় খুনের জের ধরে জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে টুপামারোরা। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে এক পানশালায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন মুজিকা। তার পেটে মোট ৬টি গুলি ঢোকে। গ্রেফতারের পর তার ঠাঁই হয় মন্টেভিডিও শহরের পান্তা ক্যারেটাস কারাগারে। সেখান থেকে দুবার পালিয়ে গিয়েও ১৯৭২ সালে ফের ধরা পড়েন মুজিকা। ১৯৭৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে উরুগুয়ের মসনদে বসেন প্রেসিডেন্ট হুয়ান মারিয়া বোর্দাবেরি। গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে শুরু হয় একনায়কতন্ত্র। মুজিকাসহ ৯জন টুপামারো বিদ্রোহীকে পাঠানো হয় সামরিক কারাগারে। শর্ত ছিল, ফের বিদ্রোহের চেষ্টা করলেই প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে।
১৯৮৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে। দীর্ঘ ১১ বছর ক্ষুদ্র সেলে বন্দি জীবন কাটানোর পর ১৯৮৫ সালে মুক্তি পান মুজিকা। ৮০ ও ৯০-এর দশকে উরুগুয়ে শাসন করে কলরাডো পার্টি। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে জয়ের কাছাকাছি এসেও হার মানে ব্রড ফ্রন্ট। তবে ৯৯ জন এমপিদের পার্লামেন্টে ঠাঁই হয় দুজন প্রাক্তন টুপামারো নেতার। এদেরই একজন হোসে মুজিকা। সেই সময় প্রতিদিন নিজের লক্কড়ঝক্কড় স্কুটার চেপেই পার্লামেন্টে যাতায়াত করতেন তিনি। সাধারণ পোশাকে চলতি ভাষায় গালাগালিতে ভরপুর তার বক্তৃতা রাতারাতি জনপ্রিয়তা পায়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে এই জনপ্রিয়তার শিখরে চড়েই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন মুজিকা। তবে তাতেও নিজেকে বদলাননি তিনি।
একসময়কার সতীর্থ বিপ্লবী লুসিয়া টোপোল্যানস্কির সঙ্গে ২০ বছর লিভ ইন সম্পর্কের পর ২০০৫ সালে বিয়ে করার ফুরসত পান এল পেপে। ফুলের বাগান ঘেরা শহরতলির তিন কামরার বাড়িতে কুকুর-বিড়াল-মুরগি আর ভেড়াদের নিয়ে সুখে সংসার পেতেছেন তারা। প্রতিবেশীরা বেশির ভাগই সমবয়সী বৃদ্ধ।
৮০’র কাছাকাছি পৌঁছে অতীতের বিদ্রোহী সত্বা কী স্তিমিত পড়েছে প্রশ্ন শুনে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে মুজিকা সাফ জানিয়ে দেন, যুগের সঙ্গে সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে বটেই। তবে পরিবর্তনের সেই ইচ্ছাটা আজও অবিকল রয়ে গেছে। শুধু বাঁধনছাড়া আবেগের বদলে জায়গা করে নিয়েছে তীব্র বাস্তব বোধ। আর সেই উপলব্ধির স্রোত বেয়ে জীবনের প্রান্তে এসেও উরুগুয়ের মঙ্গলসাধনে সমান প্রাণিত প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা। উরুগুয়েবাসীর প্রিয় “এল পেপে ” এই বৃদ্ধ বয়সেও স্বপ্ন দেখেন নিপিড়ন মুক্ত একটি নতুন বিশ্বের।