কুলি থেকে ধনকুবের, অতঃপর দেশের জন্য জীবন দান…
ইফতেখার ইফতি: উপমহাদেশর উদ্যোক্তাদের পথিকৃৎ বিখ্যাত ধনকুবের এক সময় মায়ের জন্য ডাক্তার জোটাতে পারেননি, এমনকি ওষুধ – পথ্য বা সেবাযত্ন কিছুই নয়। তখন গ্রামীণ হিন্দু সমাজে অশৌচের অজুহাতে সেবাযত্ন ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়াই ছিল নারীদের স্বাভাবিক নিয়তি। সাত বছর বয়সে মাকে হারিয়ে, সৎ মায়ের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেন মামাবাড়িতে। সেখানেও বেশি দিন টিকতে পারেননি। ঘরহারা এই মানুষটি এবার জীবন যুদ্ধ শুরু করতে পথে নামলেন। কলকাতায় কুলিগিরি দিয়ে শুরু। তারপর রিক্সা চালানো, ফেরি করা, খবরের কাগজ বিক্রি করার কাজও করেছেন বহুবছর।
এতক্ষণ যাকে নিযে বলছি তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের প্রখ্যাত সফল এক উদ্যোক্তা ও জনহৈতিসী ব্যাক্তি শহীদ রণদা প্রসাদ সাহা। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে গ্রামবাংলার আর দশজন শিশুর মতোই রণদার জীবন শুরু হয়।
পুঁথি ও প্রতিষ্ঠানের বিদ্যা অর্জন করা হয়নি কখনো।এল জি আর ডি তে নিন্মমান সহকারী থাকাকালীন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার সতীশ চৌধুরীর অর্থ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় প্রথম জীবনে কয়লা ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখেন রণদা প্রসাদ, কয়লা থেকে লঞ্চ, লঞ্চ থেকে ডকইয়ার্ড, ডকইয়ার্ড থেকে ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’- এভাবেই রণদা তাঁর ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়েছেন। নৌপথে মালামাল আনা-নেয়ার কাজে নিয়োজিত বেঙ্গল রিভার সার্ভিস প্রথমে যৌথ মালিকানায় থাকলেও পরে সব অংশীদারের অংশ কিনে নেন রণদা। এই কোম্পানির মাধ্যমেই তিনি নিজেকে একজন সফল নৌপরিবহন ব্যবসায়ী করে তোলেন।
পুঁথি ও প্রতিষ্ঠানের বিদ্যা অর্জন করা হয়নি কখনো।এল জি আর ডি তে নিন্মমান সহকারী থাকাকালীন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার সতীশ চৌধুরীর অর্থ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় প্রথম জীবনে কয়লা ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখেন রণদা প্রসাদ, কয়লা থেকে লঞ্চ, লঞ্চ থেকে ডকইয়ার্ড, ডকইয়ার্ড থেকে ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’- এভাবেই রণদা তাঁর ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়েছেন।
আর. পি. সাহা নামেই তিনি বেশি পরিচিত। জন্ম সাভারের নিকটবর্তী শিমুলিয়ার কাছৈড় গ্রামে নানার বাড়িতে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার ও মা কুমুদিনী দেবী। পৈত্রিক নিবাস টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রণদাপ্রসাদ বাংলাদেশে চলে আসেন। এ কারণে দুই দেশের ব্যবসা দু-ভাগ হয়ে যায়। গ্রামীণ সমাজ তখনও কুসংস্কারের পাঁকে ডুবে আছে। রণদার গ্রামে ফেরাটা সে সময়ের হিন্দু সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। জাত-বেজাতের সঙ্গে মেলামেশা, পথ-বিপথে ও দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো রণদাকে প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া তার সমাজ সেদিন তাকে গ্রহণ করতে চায়নি। তখন এগিয়ে আসেন মির্জাপুর গ্রামের প্রভাবশালী তালুকদার সতীশচন্দ্র পোদ্দার। গ্রাম তাঁকে গ্রহণ করতে চায়নি, কিন্তু বালিয়াটির সম্ভ্রান্ত জমিদার তাঁর কন্যা কিরণবালা দেবীর বর হিসেবে তাঁকেই গ্রহণ করলেন।
মানুষের কল্যাণকে বড় করে দেখার মানসিকতা থেকেই তাঁর ব্যবসা পরিচালিত হতে থাকে। কর্মের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন তিনি। নিম্নবিত্তের সন্তান হয়েও জীবনে কঠোর পরিশ্রম করে যে বিশাল সম্পদ তিনি অর্জন করেছিলেন তার সবটুকুই অকাতরে বিলিয়ে গেছেন। কুমুদিনী ট্রাস্ট ও ভারতেশ্বরী হোমস তারই অবদান।
রণদা সংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। সমাজের উন্নতির জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও যে সমানতালে এগিয়ে যেতে হয় সেটি জানতেন রণদা। আর সে কারণেই পাশ্চাত্য ভাবধারায় গড়ে তুলেছিলেন ভারতেশ্বরী হোমস। ১৯৪৪ সালে মির্জাপুরের মতো বদ্ধগ্রামে পাশ্চাত্য ভাবধারার এই স্কুল ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রথা ও সংস্কারের জালে বন্দি নারীদের শিক্ষিত করার চ্যালেঞ্জ তিনি নিয়ে ছিলেন সমাজপতিদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই। টাঙ্গাইলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুমুদিনী মহিলা কলেজ। এটিই দেশের প্রথম আবাসিক মহিলা ডিগ্রি কলেজ। নারী শিক্ষার পাশাপাশি পুরুষদের জন্যও মানিকগঞ্জে বাবার নামে দেবেন্দ্র সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন রণদাপ্রসাদ সাহা।
চিকিৎসার অভাবে মায়ের মতো অনেক নারীর অকাল মৃত্যু তাঁর মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। গ্রামের মানুষের সুচিকিৎসার জন্য মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুমুদিনী হাসপাতাল। তত্কালীন সময়েই এটি ছিল দেশের হাতেগোনা উন্নত চিকিত্সার সুযোগ সমৃদ্ধ হাসপাতালগুলোর একটি। রোগীদের থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সুচিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থা। কুমুদিনী হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনো শ্রেণীভেদ নেই। এখানে ধনী, গরিব, হিন্দু, মুসলমান সবাই সমান সুযোগ ও সুচিকিৎসা পায়।
১৯৭১ এ শুরু হয় বাঙালীর মুক্তির সংগ্রাম। তখন অনেকেই দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। শুভাকাঙ্ক্ষীরা রণদাকেও দেশত্যাগের পরামর্শ দেন। দেশপ্রমিক রণদা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সহযোগিতা করে যাচ্ছিলেন। তিনি দেশ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। মুক্তিবাহিনী কে সাহায্য করার কথা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদরদের কারণে জানাজানি হয়ে গেল। যারা একদিন হাসপাতালের ওষুধ-পথ্য ও চিকিৎসায় নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়েছিল তারাই শত্রুতা করল। ৭ মে দুপুরের দিকে মির্জাপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ওদুদ মাওলানা টাঙ্গাইল থেকে পাকবাহিনী নিয়ে আসে। রণদা প্রসাদ ও একমাত্র পুত্র ভবানীপ্রসাদকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁরা আর ফিরে আসেননি এবং তাঁদের কোনো খোঁজও মেলেনি। তার লাশটি আজো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখা রণদার শরীর হারিয়ে গেলেও তিনি আজীবন বেচে থাকবেন বাঙালীর হৃদয়ে।