দুনিয়া কাঁপানো স্কুল শিক্ষক ইমরান খান

দুনিয়া কাঁপানো স্কুল শিক্ষক ইমরান খান

মারুফ ইসলাম: প্রবাদ আছে, ব্যাক্তির আগে নাকি তার সুনাম ছোটে, ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ইমরানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। নইলে কি আর খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইমরানের প্রশংসা করেন!

চমকে উঠলেন? ভাবছেন, পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার-বর্তমানের রাজনীতিক ইমরান খানের কথা বলছি? কিংবা আমির খানের ভাগনে বলিউড তারকা ইমরান খানের কথা বলছি?

না ভাই। এই ইমরান সেলিব্রেটি ইমরান নন। তিনি ভারতের রাজস্থানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম আলওয়ারের বাসিন্দা ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দৌলতে ইমরানের নাম এখন লোকের মুখে মুখে, টিভিতে, সংবাদপত্রে চর্চার বিষয়।

সম্প্রতি এক সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ভিড়ে ঠাসা ব্রিটেনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে গর্বে বুক ঠুকে বলছিলেন, ইমরান খানের মতো লোকের বাস তাঁর দেশে, আলওয়ারের খানেদের তখন ভিমড়ি খাওয়ার জোগাড়। সাংবাদিকরা দ্রুত গুগুল সার্চে ইমরানের নাম বসিয়ে খুঁজে দেখছিলেন কে তিনি?

চৌত্রিশ বছর বয়সী ইমরান পেশায় আলওয়ারের এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু তিনি শিক্ষা বিষয়ক অর্ধশতকের বেশি মোবাইল অ্যাপ বানিয়ে সমগ্র ভারতে হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছেন। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ।

গুগল প্লে স্টোরে ‘gktalk_Imran’ নামের অধীনে ইমরানের ৫৩টি আ্যাপস রয়েছে। হিন্দিতে সাধারণ জ্ঞানের অ্যাপ সবচেয়ে জনপ্রিয়। পাঁচ লাখের ওপর ডাউনলোড হয়েছে এই অ্যাপ। কাজ করার জন্য ইন্টারনেট সংযোগেরও দরকার নেই। আপাতত হিন্দিতে লাইফ সায়েন্স নিয়ে ৩০০টি প্রশ্ন রয়েছে। ইমরানের অ্যাপের ব্যবহার নিয়ে প্লে-স্টোর বলেছে, ‘এই অ্যপ্লিকেশন বেসিক সায়েন্স সহজে বুঝতে সাহায্য করবে। এটা ছাত্রছাত্রীদের যেমন কাজে লাগবে, তেমনি আইবিপিএস, আইএএস, স্টেট পিএসসি, এসএসসি এবং অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষাতেও সাহায্য করবে’।

‘বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম। অঙ্ক, বিজ্ঞান আমার কাছে নেশার মতো ছিল। কিন্তু উৎসাহ বা ভরসা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। আমাদের দেশে চাকরি পাওয়াটাই যেন সবকিছু। চাকরি পেলেই সব নিশ্চিন্ত’

এক লাখেরও বেশি ডাউনলোড নিয়ে ইমরানের অন্যান্য জনপ্রিয় অ্যাপসগুলি হলো-ইতিহাস সাধারণ জ্ঞান, হিন্দি ব্যাকরণ, হিন্দিতে ভূগোলের সাধারণ জ্ঞান, ভারতীয় রাজনীতির সাধারণ জ্ঞান এবং তাঁর প্রথম অ্যাপ ‘NCERT Science in Hindi’, যেটা ২০১২ সালে তৈরি করেন তিনি। এই অ্যাপসগুলি ছাড়াও পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সৌরশক্তি, রচনা লিখন, কম্পিউটার ফান্ডামেন্টালস, মানবশরীর, মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে ইমরানের আরও কিছু অ্যাপস রয়েছে।

ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রতিভাধর যুবক বলেন, ২০১২ সালে আলওয়ারের কালেক্টর আশুতোষ এ পাদনেকর তাকে অ্যাপ বানানোর আইডিয়াটা দেন।

‘অ্যাপ কী তখনও জানতাম না। আমার মোবাইলও ছিল সাধারণ। কালেক্টর সাহেব নিজের স্মার্টফোনে কিছু অ্যাপ দেখান’ বলেন ইমরান খান।
এরপর বই পড়ে, অনলাইন সার্চ করে প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক ইমরান অ্যাপস নিয়ে বেশ খানিকটা পড়াশোনা করে নেন। ইমরানের ভাই ইদ্রিস জানান, ‘আমার কম্পিউটার সায়েন্সের বইটা ঘেঁটে ফেলেছিল দাদা’। ২০১২ সালে NCERT এর জন্য সায়েন্স অ্যাপ বানিয়ে ফেলেন। তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘নানা বিষয়ে, যেমন-ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, প্রাথমিকের বিজ্ঞান, মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান এবং যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসছে তাদের জন্যও অ্যাপস বানাই’, বলেন তিনি। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে তার অ্যাপস নিয়ে আসার জন্য মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তারপর মিষ্টি হেসে এই স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘আমর সব আ্যাপস দেশের জন্য দান করেছি।

শিক্ষক ইমরান খান
শিক্ষক ইমরান খান

উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরই শিক্ষকতাকে পেশা হেসেবে বেছে নেন ইমরান। ‘আমার বাবা একজন কৃষক। তাই আমি অঙ্ক, বিজ্ঞানে ভালো হওয়া সত্বেও তার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি বাবা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরকারি চাকরি ধরে নেওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকেন সবাই’, পুরনো কথা মনে করে বলেন ইমরান। আটকানো যায়নি মেধাবী ইমরানকে। পরে প্রাইভেটে ইংরেজি এবং অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হন তিনি। রাজস্থানের খারেদা গ্রামে ছোটবেলা কেটেছে ইমরানের। একটু বড় হতেই বুঝতে পারেন এখানে থাকা যাবে না। কারণ, বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার কোনও সুযোগ নেই। ‘বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম। অঙ্ক, বিজ্ঞান আমার কাছে নেশার মতো ছিল। কিন্তু উৎসাহ বা ভরসা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। আমাদের দেশে চাকরি পাওয়াটাই যেন সবকিছু। চাকরি পেলেই সব নিশ্চিন্ত’, ক্ষেদোক্তি করেন ইমরান।

চার ভাই তিন বোনের মধ্যে ইমরান তৃতীয়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই যুবকের উপদেশ, যুবসমাজকে ধৈর্য্যশীল হওয়ার শিক্ষা নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘যা নিয়ে তোমার উৎসাহ, সততার সঙ্গে তাকে অনুসরণ কর। যদি তাৎক্ষণিক ফল না আসে তবুও। একদিন জয় হবেই।’

এনডিটিভি, বেটার ইন্ডিয়া ডটকম এবং ইয়োর স্টোরি ডটকম অবলম্বনে ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মারুফ ইসলামfavicon

Sharing is caring!

Leave a Comment