চা বিক্রেতার ভারত জয়
শাকিল নূর : তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। কৈশরে যার অনেকটা সময় কেটেছে রেলস্টেশনে চায়ের দোকানে চা বিক্রি করে৷কিশোর মোদি আহমেদাবাদে তার ভাইয়ের সঙ্গে চা বিক্রি করেতেন। জীবনের এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রার মধ্য তিনি সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কঠোর সংগ্রাম এবং স্থির ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হবার আশায় সেই ছোটবেলায় স্বামী বিবেকানন্দের জীবন তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। মোদির আইডল বা আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ ও ইন্দিরা গান্ধী। ধর্মীয় সাধনাও তাঁকে শৈশশে ব্যাপকভাবে মুগ্ধ করেছিল। বেশ অল্প বয়সেই তিনি সন্ন্যাসব্রতের জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে সাধুদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। হিমালয়ের পাহাড়ী এলাকায় শেষ পর্যন্ত ২ বছর সন্ন্যাসজীবন কাটান।
আট বছর বয়সে মোদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের স্থানীয় শাখায় রাজনীতির সংর্স্পশে আসেন। সংঘের বালক স্বয়ংসেবক হিসেবে দলে স্থান পান তিনি। ১৭ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে যাওয়ার পর রাজকোট শহরে অবস্থিত রাম কৃষ্ণ মিশন ও তার পর বেলুড় মঠ যাত্রা করেন। আলমোড়া শহরে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একজন পূর্ণ সময়ের প্রচারক হিসেবে যোগ দেন। রাজনীতিতে জড়ানোর পরও তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূর শিক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক এবং গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। এই সংসপ্তক পুরুষ গুজরাটী ভাষায় কবিতা লিখতে ভালোবাসেন। বক্তা হিসেবে শ্রোতাদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় তিনি। সংবাদমাধ্যম তাঁকে বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করলেও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিম ও’নীলের মতে মোদি ‘মোদী অর্থনীতিতে পারঙ্গম যা দেশের নেতা হিসেবেও একটি বড় গুণ।’
‘খুবই গরিব ঘরে জন্ম আমার। যখন খুব ছোটোটি ছিলাম ট্রেনের কামরায় কামরায় চা- বিক্রি করতাম। আমার মা ছিলেন কাজের মাসি। সংসার চালানোর জন্য মা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতেন, বাসন পেয়ালা ঘটি বাটি পরিষ্কার করতেন।’
কঠোর পরিশ্রম ও দক্ষতার জন্য সবার কাছ থেকে অকুণ্ঠ প্রশংসা পান মোদি। আশির দশকের শেষ দিকে বিজেপিতে যোগ দেন। সে সুবাদে পাড়ি জমান নয়াদিল্লিতে। বিজেপির সদর দপ্তরে কয়েক বছর কাজ করেন। কঠোর পরিশ্রম আর দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন দলে। ১৯৮৭-৮৮ সময়ে তিনি বিজেপির গুজরাট ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। মূলত, এর মধ্যদিয়েই নরেন্দ্র মোদির মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৯০ সালে তিনি আদভানির নেতৃত্বে সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রথ যাত্রায় বড় ভূমিকায় ছিলেন। ২০০১ সালে দল তাকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হতে আহমেদাবাদে পাঠায়। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জেরে ধীরে ধীরে বিজেপিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করেন মোদি।
ভারতের ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে মোদিই প্রথম ‘প্রচারক’, যিনি মাত্র ১৩ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় দেশটির সবচেয়ে উন্নত গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। অথচ এর আগে প্রশাসন চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তাঁর। ২০০২ সালে গুজরাটের নির্বাচনে মোদির জয় তাঁকে আলোচনায় আনে। মোদির রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘোরে তখন থেকেই। বর্তমানে সেই মোদিই উন্নয়ন ও সুশাসনে দলীয় সামর্থ্যের প্রতীক বনেছেন। বিপুল মধ্যবিত্ত তাঁকে সমর্থন জোগাচ্ছে। তাঁর ‘আমিও পারি’ নীতি অনেকের মধ্যেই আশার সঞ্চার করেছে। আর এরই ফল হিসেবে এক দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা বিজেপি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে। হয়তো মোদির ওপর ভর করেই ভারত শাসনের স্বপ্ন দেখেছে দলটি। বিশ্লেষক নরসিমা রাও বলেন, ‘মোদি দৃঢ় প্রত্যয়ী আর ভীষণ পরিশ্রমী। পরিণতির কথা ভেবে কোনো কিছুতেই ছাড় দেননি। সাময়িক জয়ের মোহে কখনোই মোদিকে বাঁধা যায়নি। নরেন্দ্র মোদি র্নিবাচনী প্রচারের সময় বলেন, ‘খুবই গরিব ঘরে জন্ম আমার। যখন খুব ছোটোটি ছিলাম ট্রেনের কামরায় কামরায় চা- বিক্রি করতাম। আমার মা ছিলেন কাজের মাসি। সংসার চালানোর জন্য মা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতেন, বাসন পেয়ালা ঘটি বাটি পরিষ্কার করতেন।’
পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের এক ছোট শহরে নিজের ফেলে আসা দারিদ্র্যপীড়িত শৈশবের কথা বলতে বলতে জলে ভরে উঠত তাঁর দুই চোখ। কিন্তু অশ্রু গোপন করবার কোনো চেষ্টা নেই। রুমালে চোখের কোণ মুছতে মুছতে বলে যেতে থাকেন: ‘আমার পুরোটা শৈশব ছিল দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। একদিক থেকে আমার জন্য বরং দারিদ্র্যই ছিল প্রথম প্রেরণা।গরিব মানুষের জন্য কিছু করবার সংকল্প ও অঙ্গীকারটার জন্ম দারিদ্র্যই দিয়েছে।’
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় নরেন্দ্র মোদির নাম। ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই ভারতে সরকার গঠন করে। বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বারের মতো সরকার গঠন করল বিজেপি৷ ৭ এপ্রিল থেকে ১২ মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১কোটি ৪০লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷ এর পর থেকে নির্বাচনপূর্ব ও পরবর্তী সবগুলো জরিপে উঠে এসেছে মোদি ও তার দলের জয় জয়কার। সামান্য এক চা-বিক্রেতার ছেলের ভারতের ভাগ্যবিধাতা হওয়ার এই ঘটনা রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কাহিনি তাই নিম্নবর্গের ভারতীয় প্রতিনিধির ক্ষমতায়নের রূপকথা। মোদির সাফল্যের কাছে হেরে গেল অভিজাততন্ত্রের ভারত। এভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদি।
ঠিক যেন কুঁড়ে ঘর থেকে প্রাসাদে উঠে আসলেন একজন নরেন্দ্র মোদি।