সৈয়দ হক : ঢাবির ড্রপআউট বাংলা সাহিত্যের বাদশা
সৈয়দ শামসুল হক, কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক। কাব্যনাট্য, চিত্রনাট্য, সিনেমা, চিত্রকলা, ভাস্কর্যসহ শিল্পকলার বিবিধ শাখা প্রশাখার একজন সফল কারিগর। বাঙালি পাঠকরা তাই তাঁর নাম দিয়েছেন ‘সব্যসাচী লেখক’। তিনি তরুণ লেখকদের একজন আইকনও বটে। আজ এই প্রথিতযশা শিল্প-কারিগরের ৮০তম জন্মদিন। জন্মদিবসে তাঁকে প্রণতি জানাচ্ছেন মারুফ ইসলাম।
বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। বাবার এমন ইচ্ছার কথা শোনার পর ছেলে লা-পাত্তা! ছেলে নেই নেই নেই-কোথাও নেই! প্রায় বছর খানেক পর জানা গেল, ছেলে ভারতে গেছেন। সেখানে মুম্বাই শহরে এক সিনেমা প্রডাকশ হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। এই ছেলের নাম বাদশা। কালক্রমে যিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের বাদশা; যাঁকে সবাই চেনেন সৈয়দ শামসুল হক নামে।
১৯৫২ সালে সৈয়দ শামসুল হক ভারত থেকে দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়।
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ সালে কুড়িগ্রামে। বাবা সিদ্দিক হুসাইন, মা হালিমা খাতুন। আট ভাইবোনের মধ্যে সৈয়দ হক সবার বড়। তার বাবা ছিলেন পেশায় হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে সৈয়দ হক মাধ্যমিকে পড়ার সময় লেখালেখিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪৯-৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় লিখে ফেলেন দুইশ’ কবিতা। এরই মধ্যে ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ছাপা হয় প্রথম লেখা।
পিতার মৃত্যুর পর ১৯৫৬-৫৭ সালে বেশ অর্থকষ্টে পড়েন সৈয়দ হক। ওই সময় অর্থের জন্যই নিজের প্রতিভাকে পুঁজি করে তিনি শুরু করেন চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য রচনা। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সৈয়দ হক ৩০টির মতো চিত্রনাট্য রচনা করেন। সৈয়দ হকের লেখা ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘শীত বিকেল’, ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র দর্শকপ্রিয় হয়।
চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেন তিনি। ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া, রাস্তা দিয়া হাঁইটা চলে রাস্তা হারাইয়া’ প্রভৃতি গান তিনি রচনা করেন।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ `একদা এক রাজা`। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লেখা তার ছোটগল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘শীত বিকেল’, ‘রক্ত গোলাপ’, ‘আনন্দর মৃত্যু’ প্রভৃতি। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা অসংখ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘অনুপম দিন’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘স্মৃতিমেধ’, ‘মৃগয়া’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘বড়দিনের শিশু’, ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’, ‘ত্রাহি’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘মেঘ ও মেশিন’, ‘ইহা মানুষ’, ‘মহাশূন্যে পরান মাস্টার’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘আয়না বিবির পালা’, ‘কালধর্ম’, ‘দূরত্ব’ প্রভৃতি।
তাঁর লেখা নাটকগুলোর মধ্যে `পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়` এবং `নূরলদীনের সারা জীবন` সমকালীন অভিপ্রায়ের এক দৃপ্ত প্রকাশ। লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পদক, একুশে পদক, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, পদাবলী কবিতা পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, স্বাধীনতা পদকসহ অনেক পুরস্কার।
সৈয়দ হক এখনো লিখে চলেছেন অনবরত। এই ৮০-তেও তিনি চির তরুণ। তাঁর জন্মদিনে প্রমিনেন্টের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
এক নজরে সৈয়দ হকের রচনাসমূহ:
প্রবন্ধ :
- হৃৎ কলমের টানে (১ম খন্ড ১৯৯১, ২য় খন্ড ১৯৯৫)
ছোট গল্প :
- তাস (১৯৫৪)
- শীত বিকেল (১৯৫৯)
- রক্তগোলাপ (১৯৬৪)
- আরন্দের মৃত্যু (১৯৬৭)
- প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২)
- সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প (১৯৯০)
- জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০)
- শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯০)
কবিতা :
- একদা এক রাজ্যে (১৯৬১)
- বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯)
- বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৭০)
- প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩)
- অপর পুরুষ (১৯৭৮)
- পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০)
- নিজস্ব বিষয় (১৯৮২)
- রজ্জুপথে চলেছি (১৯৮৮)
- বেজান শহরের জন্য কোরাস (১৯৮৯)
- এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯)
- অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯)
- কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০)
- আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০)
- তোরাপের ভাই (১৯৯০)
- শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০)
- রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১)
- নাভিমূলে ভস্মাধার
- কবিতা সংগ্রহ
- প্রেমের কবিতা
- ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯)
উপন্যাস :
- এক মহিলার ছবি (১৯৫৯)
- অনুপম দিন (১৯৬২)
- সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪)
- নীল দংশন (১৯৮১)
- স্মৃতিমেধ (১৯৮৬)
- মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬)
- স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭)
- এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭)
- স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯)
- বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খন্ড ১৯৮৯, ২য় খন্ড ১৯৯০)
- বারো দিনের শিশু (১৯৮৯)
- বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯)
- ত্রাহি (১৯৮৯)
- তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯)
- কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯)
- শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০)
- নির্বাসিতা (১৯৯০)
- নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০)
- খেলা রাম খেলে যা (১৯৯১)
- মেঘ ও মেশিন (১৯৯১)
- ইহা মানুষ (১৯৯১)
- মহাশূন্যে পরাণ মাষ্টার
- দ্বিতীয় দিনের কাহিনী
- বালিকার চন্দ্রযান
- আয়না বিবির পালা
- কালঘর্ম
- দূরত্ব
- না যেয়ো না
- অন্য এক আলিঙ্গন
- এক মুঠো জন্মভূমি
- বুকঝিম ভালোবাসা
- অচেনা
- আলোর জন্য
- রাজার সুন্দরী
কাব্যনাট্য :
- পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬)
- গণনায়ক (১৯৭৬)
- নুরুলদীনের সারা জীবন (১৯৮২)
- এখানে এখন (১৯৮৮)
- কাব্যনাট্য সমগ্র (১৯৯১)
- ঈর্ষা
কথাকাব্য :
- অন্তর্গত
অনুবাদ :
- ম্যাকবেথ
- টেম্পেস্ট
- শ্রাবণ রাজা (১৯৬৯)
শিশুসাহিত্য :
- সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৮)
- আনু বড় হয়
- হড়সনের বন্দুক
চলচ্চিত্র :
- নিষিদ্ধ লোবান অবলম্বনে ‘গেরিলা’ ছবিটি তৈরি হয়েছে।
পুরস্কার :
- বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬৬
- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৯
- অলক্ত স্বর্ণপদক ১৯৮২
- আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩
- কবিতালাপ পুরস্কার ১৯৮৩
- লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, ১৯৮৩
- একুশে পদক,১৯৮৪
- জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক ১৯৮৫
- পদাবলী কবিতা পুরস্কার,১৯৮৭
- নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ১৯৯০
- টেনাশিনাস পদক, ১৯৯০
- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গীতিকার
- মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার ২০১১