জুতো সেলাই থেকে ফোর্বসের প্রতিষ্ঠাতা

জুতো সেলাই থেকে ফোর্বসের প্রতিষ্ঠাতা

একনামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ফোর্বস ম্যাগাজিন। তাকে নতুন করে পরিচিত করার কিছু নেই। কিন্তু ফোর্বসের প্রতিষ্ঠাতা বার্তে ফোর্বস? তাকে কতটুকু জানি; কতটুকু চিনি আমরা? ছাত্র বয়সে যিনি জুতো পালিশ করেছেন তিনি কী করে ফোর্বস ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে উঠলেন? শুনুন মারুফ ইসলামের বয়ানে।


B-C-Forbesউঠন্তি মুলো পত্তনে চেনা যায় কিংবা মর্নিং শোজ দ্য ডে-এসব প্রবাদ মিথ্যে হয়ে যায় ফোর্বসের ক্ষেত্রে। বার্তে ফোর্বস, যিনি পৃথিবীর তাবৎ সাংবাদিকের কাছে পরিচিত বি.সি ফোর্বস নামে তার জীবনের শুরু দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এই ছেলের হাতেই একদিন উঠবে সোনার দোয়াত-কলম, তিনি হয়ে উঠবেন বাণিজ্য সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং একদা বিশ্বজুড়ে প্রতিনিধিত্ব করবে তারই প্রতিষ্ঠিত ম্যাগাজিন “ফোর্বস”!

তাহলে দেখা যাক, কেমন ছিল ফোর্বসের শৈশব। ১৮৮০ সালের ১৪ মে স্কটল্যান্ডের আবার্ডিনশায়ারের নিউ দার নামের এক গ্রামে জন্ম তার। শৈশব কেটেছে নিউ দারের মাঠে মাঠে প্রতিবেশিদের গরু চরিয়ে। কখনো কখনো প্রতিবেশিদের জমিতে ধান রোপন করেছেন দিন মজুর হিসেবে। একটু বড় হওয়ার পর যখন হোয়াইটহিল স্কুলে ভর্তি হলেন তিনি, তখনও রাস্তার পাশে বসে বাবুদের জুতো পালিশ করেছেন দিনের পর দিন।

এমন শৈশব যার তার সম্পর্কে ভবিষ্যতদ্রষ্টারা আর কী বলবেন? বলেছিলেন, এ ছেলে বড় হয়ে বড়জোর জুতোর দোকানদার হবে! কিন্তু অলক্ষ্যে বসে যিনি অদৃষ্ট লিখছেন তাঁর ভাবনা তো অন্যরকম। তাই তের বছর বয়সেই শর্টহ্যান্ড লেখা শিখে ফেলেন ফোর্বস। এই বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে কম্পোজিটরের কাজ জুটে নেন পিটারহেড সেন্টিনেল নামের এক খবরের কাগজে। বছর চারেক পর যখন তার বয়স সতের তখন রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন ডান্ডি কুরিয়ার নামের এক সাপ্তাহিক পত্রিকায়। সপ্তাহে সাকূল্যে বেতন মাত্র আড়াই ডলার। তাই সই। পড়াশোনা চালাতে হবে তো!

পাশাপাশি পড়াশোনা চলছিল। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখলেন ফোর্বস। কিন্তু দিনের বেলা পত্রিকার কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে নিয়মিত কলেজে যাওয়া হচ্ছিল না তার। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ডান্ডি ইউনিভার্সিটি কলেজে (এখন ডান্ডি ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত) রাত্রিকালীন কোর্সে ভর্তি হবেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভর্তি হয়েও গেলেন একদিন। এবার দিনের বেলা ধুমছে রির্পোটিং আর রাতের বেলা পড়াশোনা। বছর খানেক পর তার পদোন্নতি হয় সিনিয়র রির্পোর্টার হিসেবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সহ-সম্পাদক এবং সম্পাদকীয় লেখক হিসেবে পদোন্নতি পান কুরিয়ার পত্রিকায়। করিয়ারে থাকাকালীন তিনি বি.সি ফোর্বস নামে লিখতে শুরু করেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতা জগতে যে নাম একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। এর মধ্যে কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন সফলতার সঙ্গেই।

6a00e55405e7ce88340128770a6b85970c-800wi১৯০১ সালে কুরিয়ার ছেড়ে দিয়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা চলে যান। এমনি এমনি যাননি অবশ্য। সেখানকার বিখ্যাত পত্রিকা জোহানেসবার্গ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ডিগার্স নিউজ ফোর্বসকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের পত্রিকায় যোগ দেওয়ার জন্য। উচ্চ বেতনের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে তিনি চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে। বছর খানেক এ পত্রিকায় কাজ করার পর তিনি যোগ দেন জোহানেসবার্গের আরেক পত্রিকা র‌্যান্ড ডেইলি মেইলে

১৯০৪ সালে ফোর্বস ফিরে আসেন স্কটল্যান্ডে। এর এক বছর পর উড়াল দেন যুক্তরাষ্ট্রে। নিজের জন্য একটি নিবাস জোগাড় করে নেন নিউ ইয়র্ক সিটিতে। ইতিমধ্যে চব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেছে তার। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যোগ হয়েছে সাংবাদিকতার নানান রসদ। এসব বিবেচনা করে নিউ ইয়র্কের জার্নাল অব কমার্স পত্রিকায় খুব সহজেই চাকরি পেয়ে যান ফোর্বস। কিন্তু এখানে যেসব বিষয়ে প্রতিবেদন লিখতে বলা হয় তাকে সেসব একবারেই নতুন ঠেকে ফোর্বসের কাছে। ফোর্বসকে বলা হয় বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন লিখতে। তাকে বলা হয় ব্যবসায় জগতে সফল ব্যাক্তিদের নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখতে। দমে না গিয়ে কাজটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেন ফোর্বস। এই চ্যালেঞ্জই তাকে এনে দেয় পরবর্তী জীবনে সাফল্য। তিনি দ্রুতই জার্নাল অব কমার্সের প্রতিবেদক থেকে বাণিজ্য সম্পাদকে পদোন্নতি পান।

সময় গড়ায়। ফোর্বসের সাংবাদিকতা চলতে থাকে। পাশাপাশি চলতে থাকে ব্যাক্তিজীবন। ১৯১৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান। তার বছর দুয়েক আগে ১৯১৫ সালে অ্যাডেলেড স্টিভেনসনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফোর্বস। তাদের ঘরে পাঁচটি সন্তানের জন্ম হয়। একটি সন্তান অবশ্য যুবক বয়সেই এক দুর্ঘটনায় মারা যায়।

বিয়ের এক বছর পর ১৯১৬ সালে ফোর্বস সিদ্ধান্ত নেন নিজেই একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করবেন। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যান ম্যাগাজিন অব ওয়াল স্ট্রিটের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ওয়ালটার ড্রেকে। দুজন মিলে পরিকল্পনা করতে করতেই বছর পেরিয়ে যায়। অবশেষে ১৯১৭ সালে আলোর মুখ দেখে ফোর্বসের প্রথম সংখ্যা- ফোর্বস : ডিভোটেড টু ডোরস অ্যান্ড ডুয়িংস। ম্যাগাজিনটির প্রধান সম্পাদকের জায়গায় জ্বলজ্বল করে ফুটে থাকে বি.সি ফোর্বসের নাম।

প্রথম সংখ্যাতেই বাজিমাত করে ফোর্বস তার নতুন আইডিয়া দিয়ে। এ সংখ্যাতে ফোর্বস প্রকাশ করেন বিশ্বের ১০০ কোটিপতীর তালিকা এবং ৪০০ সম্পদশালী মার্কিনির তালিকা।
সাফল্য দিয়ে শুরু ফোর্বস ম্যাগাজিনের যে অভিযাত্রা তা আজও অব্যাহত।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের বর্তমান সম্পাদক, বার্তে ফোর্বসের ছেলে স্টিভ ফোর্বস।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের বর্তমান সম্পাদক, বার্তে ফোর্বসের ছেলে স্টিভ ফোর্বস।

১৯৫০ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর নেন বি.সি ফোর্বস। ততদিনে তার চার সন্তান যোগ্য হয়ে উঠেছে ব্যবসা দেখভাল করার জন্য। তাদের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তিনি নিউ জার্সি শহরের অ্যাংলেউড স্কুলের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। এই শহরে একটি বাড়িও করেন বি.সি ফোর্বস। অবসরের বাকি সময়টা তিনি বই লিখে কাটাতে থাকেন। বেশির ভাগ বইই ব্যবসা সংক্রান্ত।

জীবদ্দশায় অনেক পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন বি.সি ফোর্বস। ১৯৩৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
১৯৫৪ সালের ৬ মে এই কিংবদন্তী সাংবাদিকের জীবনাবসান হয়। তার মৃতদেহ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্কটল্যান্ডে। সমাহিত করা হয় সেই আবার্ডিনশায়ারের গ্রামে, ফোর্বসেরই শেষ ইচ্ছানুযায়ী।

ব্যাক্তি ফোর্বস বেঁচে নেই কিন্তু ম্যাগাজিন ফোর্বস বেঁচে আছে এবং দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়েই বেঁচে আছে।

তথ্যঋণ : আমেরিকান ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি, অ্যামাজন ডটকম, উইকিপিডিয়া ও ফোর্বস ম্যাগাজিন।

Sharing is caring!

Leave a Comment