অভিবাসী, মুদিদোকানী অপতঃপর হোয়াটসঅ্যাপ

অভিবাসী, মুদিদোকানী অপতঃপর হোয়াটসঅ্যাপ

জ্যান কম। হোয়াটসঅ্যাপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। চল্লিশ বছরের কম বয়সী মার্কিন কোটিপতিদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৮ দশমিক ৮ বিলয়ন মার্কিন ডলার। জন্মেছেন ইউক্রেনের কিয়েভ শহরে ১৯৭৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ষোল বছর বয়সে অভিবাসী হয়ে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। আমাদের আজকের আইকন জ্যান কম। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মারুফ ইসলাম


320x486ইউক্রেনের কিয়েভ শহর থেকে আমেরিকা কতদূর? কিশোর জ্যান কমের তা জানা নেই। কেন আমেরিকায় যেতে হচ্ছে তা-ও জানা নেই। এসব প্রশ্ন একবারের জন্যও তার মাথাতে আসেনি তখন। মা আর নানি বলেছিল, ‘চল, বেরিয়ে পড়ি’; অমনি বেরিয়ে পড়েছিল কম।

জ্যান কমের বয়স তখন ষোল। বাবা কেন তাদের সফর-সঙ্গী হচ্ছে না এই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও কমের কিশোর মনে উঁকি দেয়নি। মা আর নানির হাত ধরে নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে বাড়ি ছেড়েছিল সে। যখন বাড়ির উঠোন পার হচ্ছিল কম তখন কী ভেবে একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিল, বারান্দায় ঝুলছে পোষা পাখির খাঁচা। বাতাসে মৃদু দুলছে। কমের বুকের ভিতরটাও কী একটু দুলে উঠল? ঝাপসা হয়ে এলো কী কিশোর চোখের উপকূল? সেদিন মা কিছু না বললেও, নানি কিছু না জানালেও কমের অবচেতন মন হয়ত ঠিকই জেনে গিয়েছিল, এ যাওয়াই শেষ যাওয়। আর কখনো ফেরা হবে না এ বাড়িতে। তাই দুলে উঠেছিল বুকের ভেতরটা। জলে ঝাপসা হয়ে এসেছিল চোখ।

সেই ঝাপসা চোখ নিয়েই ১৯৯২ সালের এক সন্ধ্যায় মা আর নানির সঙ্গে জ্যান কম চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। দুই ঘরের ছোট্ট একটি বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাই মেলে তাদের। মা কাজ নেন আশেপাশের বাড়িতে ‘বেবি-সিটার’ হিসেবে। কম বসে থাকার পাত্র নয়। সে একটি মুদি দোকানে কাজ জুটে নেয়। কায়ক্লেশে জীবন বয়ে যেতে থাকে তিনটি প্রাণির।

এর কিছুদিন পর জ্যানের বাবাও এসে জুড়ে বসেছিল এই পরিবারে। তারপর কী ভেবে একদিন চলেও গেল। সোজা ইউক্রেনে। আর কখনো খোঁজ রাখেনি জ্যান কমদের। বেশ কবছর পর তারা জানতে পেরেছিল, বাবা আর পৃথিবীতে নেই। ১৯৯৭ সালে মারা গেছেন তিনি।

তাতে অবশ্য জীবন থেমে থাকেনি জ্যান কম পরিবারের। মা কাজ করছেন অন্যের বাড়িতে, সে কাজ করছে মুদি দোকানে। পাশাপাশি পড়ালেখাটাও শুরু করে দেয় জ্যান কম। ভর্তি হয় স্যান জোস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। এসময় প্রোগ্রামিংয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে জ্যান কম। বছর দুয়েক পর একটি প্রতিষ্ঠানে ‘সিকিউরিটি টেস্টার’ হিসেবে একটি চাকরি মিলে যায় জ্যান কমের। পড়ালেখার ইস্তফাও ঘটে তখনই।

এরপর থেকে জ্যান কমের জীবনের গল্পটা অন্যভাবে লেখা হতে থাকে। এই গল্পের পাতায় পাতায় শুধু সাফল্য। ১৯৯৭ সাল। বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইয়াহু থেকে আমন্ত্রণ আসে ‘অবকাঠামো প্রকৌশলী’ হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য। জ্যান কম এ আমন্ত্রণে সাড়া দেন। পরবর্তী নয় বছর তিনি ইয়াহুতেই কাজ করেন। তারপর ২০০৭ সালে ইয়াহু ছেড়ে দেন কম। তাঁর মনে হয়েছিল, অনেক কাজ করেছি এবার একটু দম নেওয়া দরকার।

চাকরি ছাড়ার পর একবারে মুক্তকচ্ছ হয়ে দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরতে বের হন জ্যান কম। দর্শনীয় সব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করেন। এই সময়, ২০০৯ সালে একটি আইফোন কিনেন জ্যান। আইফোন ব্যবহার শুরু করার পর তাঁর মাথায় একটি অ্যাপস তৈরির ভাবনা চলে আসে। তিনি তাঁর ভাবনা বিনিময় করার জন্য চলে যান বন্ধু অ্যালেক্স ফিসম্যানের কাছে। ফিসম্যানের কফিশপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। কম তাৎক্ষণিকভাবে একটি নামও বের করে ফেলেন-হোয়াটসঅ্যাপ!

এর সপ্তাহ খানেক পর ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জ্যান কমের জন্মদিনে ক্যালিফোর্নিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুর করে হোয়াটসঅ্যাপন ইনকর্পোরেশন।

midas-jan-koumহোয়াটসঅ্যাপ সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রযুক্তিপ্রেমী মাত্রই জানেন, স্মার্টফোনে বার্তা আদান প্রদানের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ। বিশ্বজুড়ে হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত শ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। তবে জ্যান কম সম্পর্কে আর একটু বলার আছে। তিনি চল্লিশ বছরের কম বয়সী মার্কিন ধনীদের একজন। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিখ্যাত সাময়িকী ফোর্বসের করা অনুর্ধ্ব-৪০ বছর বয়সী সম্পদশালী মার্কিন উদ্যেক্তার তালিকায় তাঁর অবস্থান তৃতীয়। আহা! আজ যদি মা বেঁচে থাকত! মায়ের জন্য মাঝে মাঝেই চোখজোড়া ভিজে ওঠে জ্যান কমের। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০০ সালে জ্যান কমকে ছেড়ে চিরতরে না ফেরার দেশে গেছেন তাঁর মা।

খুশির খবরেও মাঝে মাঝে চোখ ভিজে ওঠে জ্যান কমের। ২০১২ সালের এক বসন্তে ফেসবুকের কর্তা মার্ক জাকারবার্গ নৈশভোজের আমন্ত্রণ করেন জ্যান কমকে। এটা একটা চমক বটে। কিন্তু জ্যান কম তখনও জানেন না তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে আরও বিস্ময়। সেই ডিনার পার্টিতে জাকারবার্গ তাকে অনুরোধ করেন ফেসবুকের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দেওয়ার জন্য! তারিখটা বেশ মনে আছে, ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি।

এর বছর দুয়েক পর হোয়টসঅ্যাপের প্রতিষ্ঠাতা ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতার কাছে ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে হোয়াটসঅ্যাপ বিক্রি করে দেন। এখন ফেসবুক ইনকর্পোরেশনের সঙ্গেই যুক্ত আছেন জ্যান কম।

তথ্যঋণ : ফোর্বস, বিজনেস ইনসাইডার, ক্রাঞ্চবেজ ও উইকপিডিয়া।

Sharing is caring!

Leave a Comment