ছাত্রের আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে : ড. শামসুজ্জোহা
আতিকুর রহমান, রাজশাহী : “আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এর পর কোন গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।” কথাগুলো বলেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। পরদিন সত্যিই তাকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভীত রচিত হয়েছিল উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই। আর যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে এ সংগ্রাম গণআন্দোলনের রূপ লাভ করেছিল, তাদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি ড. শামসুজ্জোহা, বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবার প্রিয় জোহা স্যাার। যিনি নিজের জীবন দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শিক্ষক হয়ে ছাত্রদের জন্য নিজের জীবন দিয়েছেন এমন ঘটনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া ভার।
১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন ড. জোহা। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার শাহাদাত বরণের পর ৪৬ বছর পার হয়েছে, কিন্তু রাবি পরিবার আজও ভোলেনি তাঁকে। প্রতিবছর এদিনটি পালন করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক দিবস হিসেবে।
শহীদ ড. শামসুজ্জোহা বাঙালির বীরত্বময় গৌরবগাথার ইতিহাসে চির অমর হয়ে আছেন, থাকবেনও। মূলত তার মৃত্যুর পরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। যা সামরিক জান্তা আইয়ুব খান সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে বাঙালির গণআন্দোলনে বিজয় এসেছিল।
১৯৬৯’র সেই দিনটির কিছু কথা
১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। দেশে চলছে সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান। আন্দোলনের এ হাওয়া লেগেছিল রাজশাহীতেও। বিশেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে এ আন্দোলন চরম আকার ধারন করেছিল। এসময় ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণায় পাকিস্তানি সামরিক সরকার ভীত-সন্তস্ত্র হয়ে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে পাক সেনা বাহিনী। রক্ত ঝরে শিক্ষার্থীদের শরীর থেকে। সেদিন বিকেলে এক সভায় এই ঘটনার প্রতিবাদ করে ড. শামসুজ্জোহা বলেন, “আমার ছাত্রদের উপর হামলা করা হয়েছে, তাদের রক্ত ঝড়ানো হয়েছে, আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত।”
এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে পূর্ব পাকিস্তানে ১৪৪ ধারা জারি করে পাক সরকার। কিন্তু সেসময় কোন কিছুই শিক্ষার্থীদের দমাতে পারেনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এবং মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছাকাছি যায়। এসময় সেখানে উপস্থিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। মিছিল থামিয়ে দিলেও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সরকারের বিপক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে।
“আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবেনা, যদি গুলি বর্ষণ হয় তবে কোন ছেলের গায়ে লাগার পূর্বে আমার গায়ে লাগবে, কোন ছাত্রকে গুলি করার আগে আমাকে গুলি করতে হবে।”
অবস্থা বেগতিক জানতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে ছুটে যান প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। অভিভাবক হিসেবে তিনি ছাত্রদের শান্ত করা সহ ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাত্ররা কিছুতেই পিছু হটতে রাজি নয়। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে সেখানে অবস্থান নেয়া পাকিস্তাানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হাদী আন্দোরনরত ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন।
তখন ড. জোহা পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবেনা, যদি গুলি বর্ষণ হয় তবে কোন ছেলের গায়ে লাগার পূর্বে আমার গায়ে লাগবে, কোন ছাত্রকে গুলি করার আগে আমাকে গুলি করতে হবে।” এ সময় তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘ডোন্ট ফায়ার! আই সেইড ডোন্ট ফায়ার!’। এসময় তিনি ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেন।
কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হলো না। ড. জোহার আশ্বাসে কান না দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গুলির সামনে নিজের বুক পেতে দেন সবার প্রিয় জোহা স্যার। আর সেদিন সবার আগে ড. জোহার বুকের রক্তেই রঞ্জিত হয়েছিল মতিহারের সবুজ চত্বর।
নির্মমতার এখানেই শেষ নয়। বাকি আছে আরো কিছু। গুরুতর আহত অবস্থায় ড. শামসুজ্জোহাকে হাসপাতালের পরিবর্তে তৎকালীন রাজশাহী মিউনিসিপ্যাল অফিসে নিয়ে যায় হানাদাররা। শুধু তাই নয় এরপর তার উপর বেয়োনেট চার্চও করা হয়! একটা টেবিলের উপর ফেলে রাখা হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। এসময় প্রচুর রক্তক্ষরন হলেও তখনও তাকে চিকৎসা না দিয়ে টেবিলের উপরই বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ফেলে রাখা হয়।
এদিকে ক্যাম্পাসে খবর আসে, ড. জোহাকে প্রথমে কাছ থেকে গুলি ও পরে বেয়োনেট চার্জ করে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় রাজশাহী পৌরসভার একটি পুলিশ ভ্যানে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পড়ে আছেন। পরে বিকেল চারটার দিকে রাজশাহীর তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ড. জোহাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
খবর পেয়ে শিক্ষক-ছাত্রসহ অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান হাসপাতালে। কিন্তু কিছুতেই আর শেষ রক্ষা হলোনা। প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটায় অপারেশন থিয়েটারে অনেক চেষ্টা করেও ড. জোহাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হন ডাক্তাররা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান ড. শামসুজ্জোহা।
হাসপাতাল থেকে ড. জোহার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় বিশবিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট সংলগ্ন আবাসিক শিক্ষক কোয়াটারের তার বাসায়। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে তার কফিন। সবার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের সামনে আজও চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সবার প্রিয় জোহা স্যার।
ড. জোহার পরিচিতি
ডঃ সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহার জন্ম ১ মে, ১৯৩৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায়। অধ্যাপক জোহাকে এদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবি হিসেবে গন্য করা হয়। দেশবিভাগের পর ১৯৫০ সালে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে জোহা ও তার পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাবনা জেলার বড় পাঙ্গাসীতে চলে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভােেগ স্নাতক সম্মান শ্রেনীতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএসসি অনার্স, ১৯৫৪ সালে এমএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পরে ১৯৫৭ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স এবং ১৯৬৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন । ১৯৬৮ সালের উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার কাঁধে তুলে দেয় প্রক্টরের সুবিশাল কঠিন দায়িত্ব।
ড. জোহা ও বর্তমান স্মৃতি
তাঁর মৃত্যুর পরপরই তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর নামানুসারে নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরণ করেন শহীদ শামসুজ্জোহা হল। নাটোরে তাঁর নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাঢ়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ প্রতিবছর ‘জোহা সিম্পজিয়াম’ পালন করে।
প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনগেট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থিত শহীদ ড. শামসুজ্জোহার সমাধি।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে ড. শামসুজ্জোহা স্মৃতিফলক ও মাজার। শহীদ হওয়ার ৪৭ বছর পর ড. জোহার স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে নির্মিত হচ্ছে ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিফলক ও মাজার। বর্তমানে মাজার নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যেজন্য গর্ববোধ করে থাকে তা হচ্ছে, স্বাধীনতার প্রাথমিক সোপান রচনায় প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার অবদান। যা কখনো ভোলার নয়।
দিবসটি এখন পালিত হয় ‘জোহা দিবস’ হিসেবে। আর প্রতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন হয় স্মরণীয় এ দিনটি। কিন্তু এখাানকার সকলের দাবি, দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের।
বাংলাদেশে বছরে অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হলেও এ দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা হয় না আজও! অথচ দিনটিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করার সরকারি ঘোষণার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতি।
সেইসাথে ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিকে আগামী প্রজন্মের মাঝে ধরে রাখতে পাঠ্যপুস্তকে তার আত্মদানের কাহিনী অন্তর্ভুক্ত করা এখন যেন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।