মুক্তিযোদ্ধা গানের যোদ্ধা
বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত যাঁর হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তিনি আজম খান। ভালোবেসে ভক্ত-শ্রোতারা তাঁর নাম দিয়েছেন ‘পপগুরু’। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের উত্তাল সময়ে পায়ে হেঁটে আগরতলা গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ নিতে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে নামেন বাংলা পপ সংগীতকে জনপ্রিয় করতে। সেখানে পথিকৃতের আসন লাভ করেন তিনি। হয়ে ওঠেন পপ সম্রাট। আজ এই গুণী শিল্পীর জন্মদিন। আজম খানকে স্মরণ করে লিখেছেন তাঁর ভাই প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আলম খান।
জন্ম হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর আজমকে প্রথম দেখি। আম্মার পাশে চুপচাপ শুয়ে আছে। চোখ মেলে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। কোনো কান্নাকাটি নেই। আমি আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও কে? আম্মা বললেন, ‘তোমার ছোট ভাই।’ আমি বললাম, ‘ও কি বোবা নাকি?’ আম্মা বললেন, না, বোবা না। ও কথা বলতে পারে, গান গাইতে পারে।
আম্মার সেদিনকার কথাটা পরবর্তীকালে সঠিক হয়েছে, যা আমার প্রায়ই মনে পড়ে।
আজম ছোটবেলা থেকেই ঝামেলামুক্ত থাকতে পছন্দ করত। কাউকে ঠকানো পছন্দ করত না। এখনো কোনো অবিচার বা অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে। বাবা আফতাবউদ্দিন খান সরকারি কর্মচারী ছিলেন। সেই সুবাদে আজিমপুর কলোনিতে ফ্ল্যাট পান। সেখানেই পরিবারের সবাই থাকতাম। পলাশী ব্যারাক প্রাইমারি স্কুলে দুই ভাই পড়তাম। ও ছাত্র হিসেবে আমার চেয়ে অনেক ভালো ছিল। আমি পঞ্চম শ্রেণীতে, আজম তখন ওয়ানে পড়ত। আজম কোনো কিছু অল্পতেই আয়ত্ত করতে পারে। যেটা আমি পারি না।
আজম অবচেতন মনেই আমার অনুসারী ছিল। যেমন—একদিন স্কুলে প্রধান শিক্ষক স্কুলের বারান্দায় আমাদের দুজনকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা দুই ভাই? আমরা বললাম, হ্যাঁ। স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী। আমি বললাম, আমার ভালো নাম খুরশীদ আলম খান। আজমের ভালো নাম মাহবুবুল হক খান। স্যার যখন আজমকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? আজম বলল, আমার নাম খুরশীদ আজম খান। এ নিয়ে আমি ছোটবেলায় বেশ রসিকতা করতাম। পরবর্তী সময়ে দেখলাম ও আমার সংগীতজগতেই এল। তবে একটু ভিন্নভাবে।
আজিমপুরে আজমের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যেটা সে এখনো ভুলতে পারে না। জন্মের পর যে ফ্ল্যাটে বড় হয়েছে আজম, এখনো প্রায়ই ওই ফ্ল্যাটের বাইরে থেকে ঘুরে দেখে আসে ও। আমার বাবার কবর আজিমপুর গোরস্তানে। সেখানে গেলে তো ওই ফ্ল্যাটের কাছে যাবেই। ছোটবেলার সেই খেলার মাঠ, শাহ সাহেবের বাড়ি, বাগানের ফুল চুরি করা ইত্যাদি সব মিলিয়ে আজিমপুরে আজমের ও আমার অনেক স্মৃতি বিদ্যমান। ১৯৫৮ সালের দিকে আমরা চলে আসি কমলাপুরে। সেখানে আমরা একসঙ্গেই খেলাধুলা করতাম।
বাবার বকা খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য দুজনে বাইরে থেকে গল্প সাজিয়ে নিয়ে যেতাম। কারণ, বাবার হুকুম ছিল সূর্য ডোবার এক মুহূর্ত পরে ঘরে ঢোকা যাবে না। তাহলে কড়া মার খেতে হবে। দেরি হলে একেক দিন একেক গল্প বানিয়ে নিয়ে যেতাম। সরদার বাড়ি। আফিরউদ্দিন সরদারের একটি সুন্দর মনোরম বাগানবাড়ি ও একটি বড় পুকুর ছিল, যেখানে আমি ও আমার বন্ধুরা প্রতি শুক্রবার সাঁতার শিখতে যেতাম। একদিন আজম বায়না ধরে, সেও সাঁতার শিখবে। বললাম, ঠিক আছে, আগামী শুক্রবার তোমাকে নিয়ে যাব। যথারীতি শুক্রবারে আজম আমাদের সঙ্গে সাঁতার শিখতে গেল। আজম পুকুরে নেমেই প্রথমে পুকুরের মাঝের দিকে সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে যাওয়া শুরু করল এবং ধীরে ধীরে গভীর পানিতে ডুবতে শুরু করল। আমি তখনো সাঁতার শিখিনি। ভাগ্য ভালো, আমাদের মধ্যে আমার এক বন্ধু, নাম রহমতউল্লাহ, সে সাঁতার জানত। সে দ্রুত গিয়ে আজমকে চুল ধরে টেনে পাড়ে নিয়ে আসে। ওপরে তুলে পরে পেট টিপে, নাক-মুখ দিয়ে পানি বের করা হয়। পরে আযম ভালো সাঁতার শেখে এবং পরে আজম ঢাকা স্টেডিয়ামে সুইমিংপুলে নিয়মিত দুপুরে বাচ্চাদের সাঁতার শেখাত।
আজম খান যখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভার্সিটিতে যাবে, ওই সময় শুরু হয়ে গেল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আজম চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। যাওয়ার আগে আব্বা আফতাবউদ্দিন খানকে বললেন, ‘আব্বা, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি।’ আব্বা উত্তর দিলেন, যুদ্ধে যাচ্ছ যাও, তবে দেশ স্বাধীন করে ফিরবে। আজম বলল, ‘আমার জন্য দোয়া করবেন।’ আজম আগরতলা মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে, সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নেমে গেল। কমান্ডার হিসেবে আজমের অধীনে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ২২ জনের মতো।
আজম খান, সাদেক হোসেন খোকা, মোফাজ্জল হোসেন মায়া তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রত্যেকে প্রায় একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যায়। আজম খান ঢাকার আশপাশে অনেক অপারেশন করেছে, যার প্রতিটি খবর তার সঙ্গীদের মাধ্যমে আমার কাছে অপারেশনের আগেই আসত। কারণ, তার সহযোগীরা আমার কাছে সব সময় টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সাহায্যের জন্য আসত। আমি তাদের সহযোগিতা করতাম।
এ তো গেল মুক্তিযুদ্ধের কথা। এবার আসি তার সংগীতের কথায়। আজম ছোটবেলা থেকেই মোটামুটি গানের চর্চা করত। একাত্তরের আগে আজম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণসংগীত গাইত। ও মূলত গণসংগীতই ভালোবাসত। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আজম কেন যেন একটু বিষন্নতায় ভুগতে থাকে। এ নিয়ে সে একটি গানও করেছে। একদিন আমাকে এসে আজম বলে, ‘মেজ ভাই, আমি আপনারা যে ধরনের গান করছেন, তার চেয়ে কিছু ব্যতিক্রম গান করতে চাই।’ আমি বললাম, সেটা কী রকম। ও বলল, ‘আপনারা তবলা, ঢোল, সেতার, বেহালা দিয়ে গান করেন। আমি এর পরিবর্তন আনতে চাই।’ আবার বললাম, কী রকম। ও বলল, ‘আমি বাংলা গানই করব, কিন্তু তার সঙ্গে ড্রাম, গিটার দিয়ে মিউজিক করব অর্থাৎ বাংলা ব্যান্ডসংগীত শুরু করতে চাই।’ আমি বললাম, খুব ভালো উদ্যোগ। শুরু করো, আমি তোমাকে যতটা পারি সহায়তা করব। তার পর থেকে শুরু ব্যান্ডসংগীত।
মনে আছে, ও যেদিন প্রথম ব্যান্ড দল নিয়ে বাসায় মহড়া শুরু করে, তখন বাড়ির সামনের রাস্তায় কয়েক শ লোক জড়ো হয়ে গান শুনছিল। ‘আলাল দুলাল’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না’—এই চার গান দিয়েই প্রথম ওয়াপদা মিলনায়তনে অনুষ্ঠান করে। আমি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আমি ইতিপূর্বে এ রকমভাবে দর্শকদের আর কখনো নাচতে নাচতে আনন্দ করতে দেখিনি। চারটি গানই তখন আজমের সম্বল ছিল। একই অনুষ্ঠানে এই গান চারটি দর্শক চার-পাঁচবার শুনছিল এবং প্রতিবারই নেচে নেচে আনন্দ করেছে তারা। এই অনুষ্ঠানের পর থেকেই আজমের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে।
আমি আজমকে দিয়ে আমার সুরে প্রথম প্লেব্যাক করাই ঘর ভাঙ্গা ঘর ছবিতে। গানটি ছিল—
মানুষ নামের খেলনা বানাইয়া
চাবি দিয়া দিছ ছাড়িয়া
যখন প্রথম তাকে ছবির গান গাওয়ার প্রস্তাব দিই, ও একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বলে, আমি কী ফিল্মের গান গাইতে পারব। আমি বললাম, হ্যাঁ পারবে। আজম বলল, আমার একটা প্রস্তাব আছে। আমাকে চার দিন আগে গানটা ক্যাসেট করে দিতে হবে। আমি ভালো করে শিখে গাইব। আমি চার দিন আগেই গান ক্যাসেটে তুলে দিই। ও শিখে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াল। দেখা গেল একেবারেই নার্ভাস, ঘেমে গেছে। আমাকে কন্ট্রোল রুমে এসে বলে, আমি পারব না। অন্যকে দিয়ে গানটা করান। আমি বললাম, একটা মনিটর টেক করে দেখি কেমন হয়। ও বলল, ঠিক আছে। বললাম, তুমি সিরিয়াসলি গাইবে। কিন্তু ও বলে, ঠিক আছে। কী যেন বলে এক চিৎকার দিল। তারপর মনিটর টেক করলাম। ওই মনিটার টেকই ‘ওকে’ হয়ে গেল। আসলে স্টেজে গেয়ে অভ্যাস তো, স্টেজে একবারেই ‘ওকে’ হয়। পরে সে আমার সুরে আরও অনেক ছবিতে গান গেয়েছে।
একনজরে আজম খান
পুরো নাম: মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান।
জন্ম: ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০।
জন্মস্থান: ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টার, আজিমপুর কলোনি, ঢাকা।
স্কুল: ১৯৫৫ সালে প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন।
কলেজ: ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি।
পেশা: সংগীতশিল্পী।
বিশেষত্ব: দেশপ্রেমিক ও মানবদরদি, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, বাংলা পপসংগীতের জনক।
উপাধি: পপসম্রাট আজম খান, কিংবদন্তি আজম খান, গুরু নামে খ্যাত।
মায়ের নাম: মৃত জোবেদা খানম।
বাবার নাম: মৃত মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান।
বাবার পেশা: অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট। ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক ছিলেন।
আযম খানের বিয়ে: ১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে তিনি বিয়ে করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর।
স্ত্রীর নাম: সাহেদা বেগম।
প্রথম সন্তান: ইমা খান।
নাতনি: কায়নাত ফাইরুজ বিনতে হাসান।
দ্বিতীয় সন্তান: হৃদয় খান।
তৃতীয় সন্তান: অরণী খান।
বড় ভাই: সাইদ খান।
পেশা: সরকারি চাকরিজীবী।
মেজো ভাই: আলম খান।
পেশা: গীতিকার ও সুরকার।
ছোট ভাই: লিয়াকত আলী খান। মুক্তিযোদ্ধা।
পেশা: ব্যবসায়ী।
ছোট বোন: শামীমা আক্তার খানম।
মৃত্যু: ৫ জুন, ২০১১।
ঋণস্বীকার :২০১০ সালের ২২ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংগীত পরিচালক আলম খানের লেখা ও উইকিপিডিয়া।