দুঃসময়ে পরিবারই আমাকে হাসায় : বিয়ার গ্রিলস

দুঃসময়ে পরিবারই আমাকে হাসায় : বিয়ার গ্রিলস

  • মো. সাইফ

6c1a878052ac72d3fae0e578db0709a3‘ছুঁয়ে দিলেই হয় সোনা’-কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি কাকতালীয় ভাবে মিলে যায়। মাইকেল বিয়ার গ্রিলস এমনই একজন।

আসল নাম এডওয়ার্ড মাইকেল গ্রিলস। তবে ডিসকভারি চ্যানেলে ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ শো-টি যারা দেখেছেন তারা তাকে বিয়ার গ্রিলস নামেই চেনেন। অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমিক গ্রিলস দুঃসময়েও কীভাবে লড়াই করে টিকে থাকা যায়, জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দারুণ সব অভিযানের গল্প নিয়ে ডিসকভারি চ্যানেলে হাজির হন। অসম্ভব জনপ্রিয় ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড জায়গা করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ১ নম্বর টেলিভিশন শো হিসেবে।

১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহন করেন গ্রিলস। তখন কে-বা জানতো এই ছেলেটিই বিস্ময়কর সব কাণ্ড করে তাক লাগিয়ে দেবে পুরো বিশ্বকে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্ট জয় করে হৈ চই ফেলে দেন তিনি। সর্বকনিষ্ঠ ব্যাক্তি হিসেবে তার এভারেস্ট জয়ের গল্প রোমাঞ্চ ছড়ায় অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীদের মনে। এই প্রসঙ্গে বিয়ার গ্রিলস বলেন, ‘আমি এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি আট বছর বয়স থেকেই। আমার বাবা আমাকে একটি এভারেস্টের ছবিসহ পোস্টার এনে দিয়েছিলেন। আমি সেটি আমার শোবার ঘরে রেখেছিলাম যা আমাকে অনুপ্রাণিত করতো।’

বিয়ার গ্রিলস ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করার সময় একবার এক ভয়াবহ দূর্ঘটনার কবলে পড়েন। স্পেশাল এয়ার সার্ভিসে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে যুক্ত ছিলেন। এই সময় জাম্বিয়ায় বিমান থেকে প্যারাশ্যুট থেকে লাফ দিতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায় এবং চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে নেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। হতাশ হলেও দম হারাননি তিনি। অদম্য গ্রিলস তাই মাত্র বারো মাসেই সুস্থ হন এবং ১৯৯৮ সালে সকল প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে এভারেস্ট জয় করেন। ২০০৪ সালে গ্রিলসকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সম্মানসূচক পদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডারে পদোন্নতি দেওয়া হয় মানবসেবায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য।

বেশ কিছু বই লিখে নিজের লেখনীস্বত্তাকেও প্রকাশ করেছেন তিনি। তার প্রথম বই এর নাম ‘ফেসিং আপ’। বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয় এই বইটি। নিজের এভারেস্ট জয়ের গল্প নিয়ে লিখেন দ্বিতীয় বই  ‘ফেসিং দ্য ফ্রোজেন অশেন’। এই বইটি উইলিয়াম হিল স্পোর্টস এর ‘বুক অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পায়। তার তৃতীয় বই ‘বর্ন সারভাইভর’ সানডে টাইমসের সেরা দশ বিক্রীত বইয়ের স্থান দখল করে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত গ্রিলস প্রকাশিত বই সংখ্যা ১১টি যার মধ্যে রয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য লিখা চারটি বইও। তবে পাঠক গ্রিলস এর জীবন পরিবর্তনে যে বইটি ভূমিকা রাখে সেটি হচ্ছে স্কট আলেক্সান্ডারের লিখা ‘রিনোক্যারাস সাকসেস’। গ্রিলস বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৪ তখন আমি এই বইটি পড়েছি। এটি আমাকে জীবনে সাহসী হয়ে চলার অনুপ্রেরণা দেয়। কিছু ভালো বন্ধুদের নিয়ে চলতে শেখায়।’

Build a den
দুই সন্তানের সঙ্গে বিয়ার গ্রিলস। ছবি : সংগৃহীত।

ব্যাক্তিগত জীবনে বিয়ার গ্রিলস কনজারভেটিভ পার্টির রাজনীতিক স্যার মাইকেল গ্রিলস ও লেডি সারা গ্রিলসের সন্তান। বাবাই তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।ছোটবেলায় বাবার কাছেই পর্বতারোহণ ও নৌকা চালনা শেখার হাতেকড়ি তার। কৈশোরেই গ্রিলস স্কাইডাইভিং এবং কারাতে শেখেন।আট বছর বয়সে তিনি কাব স্কাউটের সদস্য হন।২০০৯ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ চিফ স্কাউট হিসেবে নিযুক্ত হন। বিয়ার গ্রিলসের বড়বোন লারা ফাউসেট যিনি পেশায় একজন টেনিস কোচ তিনিই গ্রিলসের জন্মের এক সপ্তাহের মাথায় তাকে ‘বিয়ার’ বলে ডাকতে শুরু করেন। সেই নামটিকেই নিজ-কর্মের গুণে বিখ্যাত করেছেন বিয়ার গ্রিলস। তিন পুত্র সন্তানের জনক গ্রিলস ২০০০ সালে সারা কেনিংসকে বিয়ে করেন। পরিবারকে অনেক ভালবাসেন তিনি। দুঃসময়ে তারাই তাকে হাসায় বলে জানান তিনি।

বিয়ার গ্রিলসের এভারেস্ট জয় নিয়েই নির্মিত হয় একটি বিজ্ঞাপনচিত্র। এটিতে অংশ নিয়েই টেলিভিশন জগতে পা রাখেন তিনি। এর পর বিভিন্ন টক শো-ফ্রাইডে নাইট উইথ জোনাথন রোজ, অপরাহ উইনফ্রে শো, দ্য টু নাইট উইথ যে লোনা, দ্য লেট শো ডেভিড লেটারম্যান ইত্যাদি টেলিভিশন প্রোগ্রামে তিনি অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকা বিষয়ক অনুষ্ঠান করেন তিনি যা তাকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়।

ওর্স্ট কেস সিনারিও নামে একটি অনুষ্ঠান তিনি করেন। খুব খারাপ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কৌশল শেখানো হয় এই অনুষ্ঠানে।‘গেট আউট এলাইভ উইথ বেয়ার গ্রিলস’ নামে একটি সম্পূর্ন নতুন একটি গেম শো করেন তিনি। সাহারা মরূভূমিতে প্রশিক্ষণের উপর তৈরি করেন ‘এস্কেপ টু দ্য লিজিওন’ নামে আরেকটি অনুষ্ঠান। তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান ‘সারভাইভর : ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ করে। যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোরের জন্য নির্মিত হয় ‘বর্ন সারভাইভর : বিয়ার গ্রিলস’ নামে অনুষ্ঠানটি। এটিই অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রে ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ নামে প্রচারিত হয়।

বিয়ার গ্রিলসের মতে মানুষের ইচ্ছাশক্তিটাই আসল। প্যারাস্যুট দূর্ঘটনার পর চিকিৎসক তাকে জানিয়েছিলেন তিনি আর হাঁটতে পারবেন না। যদি সেটাকে বিশ্বাস করে তিনি আর হাঁটার চেষ্টাই না করতেন তাহলে আজ তিনি পৃথিবীর ৭০০ কোটি সাধারণ মানুষদের একজন হয়েই বেঁচে থাকতেন। তবে তার ইচ্ছাশক্তি তাকে সাধারণ করে রাখেনি। তিনি বলেন, ‘দুঃখ করে বসে থাকার জন্য আমি খুব একটা উপযুক্ত মানুষ নই। অনেক কষ্টের দিন আমি অতিবাহিত করেছি জীবনে, অনেক দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছি যার সমষ্টি আমাকে আজকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। শোক ক্ষণস্থায়ী তবে তা মানুষকে শক্তিশালী করে দিয়ে যায়।’

তথ্যঋণ : ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউকে, বিয়ারগ্রিলসডটকম, উইকিপিডিয়া।favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment