সাক্ষাৎকার : তরুণদের জেনে বুঝে বিনিয়োগে আসতে হবে
- লিডারশিপ ডেস্ক
পড়াশোনা শেষ করে আইটি প্রফেশনাল হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। ২০০৬ সালে মশিউর সিকিরিটিজের মাধ্যমে তার পুঁজিবাজারে ক্যারিয়ার। এরপর ২০০৭ সালে থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আইডিএলসি সিকিউরিজে ও ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেডের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে শেলটেক ব্রোকারেজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। বলছিলাম, স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্বাসী মঈন উদ্দিনের কথা। তিনি চাকরির শুরু থেকে যত জায়গায় কাজ করেছেন; রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। মাত্র দুই বছরে শেলটেক ব্রোকারেজকে নিয়ে এসেছেন শীর্ষ দশে। আজ থাকছে এই সফল ব্যাক্তিত্বের সাক্ষাৎকার।
: বর্তমান বাজার নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মঈন উদ্দিন: বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটের কারণে বারবার বাজার হোঁচট খাচ্ছে। দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও দাঁড়াতে পারছে না। এর ফলে টাকা থাকা সত্ত্বেও অনেক বিনিয়োগকারী বাজারে আসছে না। বাজার নিয়ে ইতিবাচক কথা-বার্তা বলার সঙ্গে সঙ্গে সরকার যদি তা বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতো তাহলে এই আস্থার সংকট দূর হতো। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরলেই এই অবস্থার উন্নতি হবে।
বর্তমান বাজার নিয়ে আমি দুইটি বিষয়ে কথা বলতে চাই। একটি হলো- প্রতিদিনের লেনদেন। অন্যটি হলো ব্রোকারদের কমিশন।
আমাদের বাজারে প্রতিদিন যে পরিমাণ লেনদেন হয়; তার মধ্যে অনেক লেনদেন ব্লকে। ব্লকের লেনদেন বাদ দিলে প্রকৃত লেনদেন কিন্তু বেশি না। এর মধ্যে যদি আবার শীর্ষ ব্রোকারদের অংশ বাদ দেওয়া হয়, তাহলে বাকি ব্রোকারদের ভাগে কী পড়ে?
অন্যদিকে ব্রোকারদের কমিশন নিয়ে বিনিয়োগকারীরা যেভাবে তর্কবিতর্ক করছে সেটি একটি সমস্যা। এর সুযোগ করে দিয়েছে ব্রোকাররাই। এতে করে সবারই আয় কমছে। বেশি সমস্যায় পড়ছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ তাদের যে পরিমাণ ব্যয়; আয় সে পরিমাণ নেই।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ধরেন একজন গ্রাহককে ‘এ’নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৫০ পয়সা কমিশন দিচ্ছে। ‘বি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ওই গ্রাহককে ৪৫ পয়সা অফার করছে। ‘সি’নামের আরকেটি প্রতিষ্ঠান সেটি এর চেয়ে কমিয়ে দিচ্ছে। এ বিষয়ে আমার কথা হলো একটি প্রফেশনাল প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ কমিশন নিবে; সেই পরিমাণ সার্ভিস ওই বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে। এমন বাস্তবতায় এখন মার্কেটে কোয়ালিটি একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।
: ব্রোকারদের কমিশনের যে সমস্যা সেটি সমাধানে আপনাদের অ্যাসোসিয়েশনের কী কোনো উদ্যোগ নেই?
মঈন উদ্দিন: এই সমস্যা সমাধান করতে হবে ডিএসইকে। তবে সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ অ্যাসোসিশেনকেই নিতে হবে। তারা বিষয়গুলো আলোচনায় নিয়ে আসলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর সমাধান করবে। অ্যাসোসিয়েশনে সেভাবে কোনো নির্বাচন হয়নি, বিধায় কেউ এটা নিয়ে গুরুত্ব দেয় না।
: আপনি বলছিলেন, বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। আস্থা ফেরানোর উপায় কী?
মঈন উদ্দিন: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে ইতিবাচক ঘোষণার পরও সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। উপর মহল থেকে নেওয়া পদক্ষেপগুলো যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসতে পারে। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানিগুলো নিয়ে কারসাজি, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অস্বচ্ছতা, বিনিয়োগকারীদের গুজব নির্ভরতা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান হলেই বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হবে বলে আমার ধারণা।
: ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে একটি কথা উঠেছিল, বাজারে কেউ সাপোর্ট দেন না। ব্রোকাররা একটি ডিলার হিসাবে আছে; সেখানে লেনদেন করলেও বাজারে একটি সাপোর্ট হয়। এটা নিয়ে আপনাদের অবস্থান কি?
মঈন উদ্দিন: প্রতিষ্ঠানের তো নিজস্ব বিনিয়োগ আছে। প্রতিষ্ঠান সক্ষমতা অনুযায়ী বাজারে বিনিয়োগ করে। আমার সক্ষমতা যদি না থাকে তাহলে আমাকে চাপ দিলে কী বিনিয়োগ করতে পারবো? তবে সরকার যদি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে দেয়; তাহলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে। যদি বাজারে বিনিয়োগের পরিবেশই না থাকে তাহলে কেন তারা বাজারে আসবে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে পরিবেশ কী? এটা হলো- ব্যাংক এখন ৬ শতাংশ পেইড করে আর মূল্যস্ফীতি হলো ৭ শতাংশ। কেউ যদি মনে করে সে এক লাখ টাকা ব্যাংকে রাখবে, তাহলে বছর শেষে পাবে ১ লাখ ৬ হাজার টাকা। ৬ শতাংশ লাভ পেয়েছে। এখন ১ লাখ টাকা দিয়ে গত বছর যা করা যেতো এ বছর কি তা করা যাবে? যাবে না। কারণ ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যোগ করতে হবে। যার অর্থ হলো আপনার তহবিলের প্রবৃদ্ধি কিন্তু নেগেটিভ। এটা হলো গড় মূল্যস্ফীতি। আর স্বতন্ত্রভাবে যদি চিন্তা করেন তাহলে এর পরিমাণ আরও বেশি হবে।
: যে জন্য মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠিত হয়েছে, বর্তমানে কী সে উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে?
মঈন উদ্দিন: এ নিয়ে আমার দুটি অভিমত। এক হলো মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে এটি গ্রো করছে না। অন্যদিকে আমাদের দেশের ফান্ডগুলো আকারেও ছোট। ফান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব না থাকার ফলে এই ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছে না।
যেমন একটি ফান্ডের অফার মূল্য ১০ টাকা। প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) তার চেয়ে বেশি। বাজারে ওই ফান্ডের লেনদেন হচ্ছে ৬ টাকা। লভ্যাংশ দিচ্ছে ১০ শতাংশ নগদ। তার মানে ইউনিটহোল্ডাররা ২০ টাকা দরে লভ্যাংশ পাচ্ছে। তারপরও কিন্তু মানুষ বিনিয়োগ করছে না। তাহলে কি বলবেন, তারা ভালো বোঝে না?
আরেকটি বিষয় হলো- একটি ফান্ডের এক লক্ষ্য ইউনিট আছে। এর যদি ৬০ শতাংশ ফ্রি ফ্লোরড হয়ে যায়, তাহলে ৪০ শতাংশ থাকে স্পনসরের কাছে। এখন এই ৬০ শতাংশের মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরির বিনিয়োগকারী আছে। তাহলে দেখা যায় ৬০ শতাংশের বেশির ভাগ থাকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে। যদি এর বেশির ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকে; তাহলে অবশ্যই দাম স্থির থাকতো।
: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন প্রতিষ্ঠানের হাতে বেশি ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।
মঈন উদ্দিন: অবশ্যই। প্রতিষ্ঠানের কাছে বেশি পরিমাণ থাকলে বাজার টাল-মাটাল হবে না। কারণ তারা এগুলো বিক্রি করে বাসার জন্য টিভি বা ফ্রিজ কিনবে না। তারা দীর্ঘমেয়াদে বাজারে বিনিয়োগ করবে। এতে করে বাজার স্থিতিশীলতার দিকে যাবে।
: ব্যাংকগুলোর বাড়তি বিনিয়োগ বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে সমন্বয় করছে; সে বিষয়ে আপনার মত কী?
মঈন উদ্দিন: ব্যাংকগুলোর বাড়তি বিনিয়োগ বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে ঠিক করছে তাতে কী স্থায়ী কোনো সমাধান হচ্ছে? আমার মনে হয়- হবে না।
: তাহলে স্থায়ী সমাধান কী?
মঈন উদ্দিন: এটি হলো- আপনার ৪ হাজার কোটি টাকা বাড়তি বিনিয়োগ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বললো যে ঠিক আছে এ ৪ হাজার কোটি টাকা সমন্বয় করতে হবে না। বছর শেষে গিয়ে সুদসহ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হয়ে গেল। এখন এই বাড়তি ৫০০ কোটি টাকা আমাকে সমন্বয় করতে হবে না! তাহলে বাজার বাড়বে কিভাবে? বাজার বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এখন কী বিনিয়োগ বাড়ছে? বাড়ছে না। যাদের বিনিয়োগ করার সামর্থ্য আছে তারা করছে না।
: বাজারের এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের করণীয় কী?
মঈন উদ্দিন: বাজারকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল করে তোলার জন্য বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারাই বাজারের মূল চালিকাশক্তি। তারা যদি কারো কথায় কান দিয়ে বিভ্রান্ত হয়, তাহলে বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। পুঁজি বিনিয়োগে ঝুঁকি এড়াতে হলে জেনে ও বুঝে বিনিয়োগে আসতে হবে। বিনিয়োগের সময় গুজব বা কানকথা নয়, কোম্পানির সার্বিক অবস্থা ও অতীত রেকর্ড বিবেচনা করতে হবে। এই সব বিষয় দেখে বিনিয়োগ করবে। তাহলেই তারা সফলতার দৌঁরগোড়ায় পৌঁছতে পারবে।
: শেলটেক নিয়ে একটু বলেন, কেন একজন বিনিয়োগকারী আপনার এখানে আসবে?
মঈন উদ্দিন: দেখুন আমি যখন শুরু করি তখন এটি ছোট প্রতিষ্ঠান ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিনিয়োগকারী সর্বোপরি আমার পরিচালনা পর্ষদ, সবার সহযোগিতা নিয়ে আল্লাহর অশেষ রহমতে শেলটেক এখন শীর্ষ দশে অবস্থান করছে।
আমার পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা শুরু থেকেই সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছে। কোনো কাজে কখনো হস্তক্ষেপ করেনি। আমাকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার পর সব কিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাকে তারা দিয়েছে। আমি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তারা তা বাস্তবায়ন করেছে। এটা হলো শেলটেকের মূল্য সৌন্দর্য্য। অন্যদিকে এখানে যারা কাজ করে সব প্রফেশনাল। সুতরাং তারা বোঝে কীভাবে পরিচালনা করতে হবে।
দ্বিতীয় কথা হলো, এখানে যারা কাজ করছে একেবারে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত; সবাই ডেডিকেটেডলি কাজ করছে। আমাদের স্লোগানই ছিল আমরা গ্রাহকদের জন্য কাজ করবো। ফলে আজকে আমরা এই পর্যায়ে এসে দাঁড়াতে পেরেছি।
: এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।