মজিবর রহমান : সাফল্যের এক নিপুণ কারিগর
- রবিউল কমল
চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি পছন্দ করেন। সততা, ব্যবহার আর শ্রমের বিনিময়ে এ চ্যালেঞ্জকে তিনি জয়ও করেছেন। সফলতাকে এনেছেন হাতের মুঠোয়। আর তাই আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও এক আলোকিত নাম বিআরবি ক্যাবল। এর কর্ণধার মো. মজিবর রহমান। কুষ্টিয়ার এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে বেড়ে ওঠা। ফলে ছোট থেকে হিসাবের হাত একেবারে পাক্কা। চল্লিশ বছর ধরে এ পাক্কা হিসাবি মজিবর রহমান ব্যবসাকেও নিয়ে গেছেন পাক্কা খুঁটিতে। অন্যতম বিশ্বে বাংলাদেশের শীর্ষে- এ স্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তর তর করে।
বেশিদিন আগের কথা নয়, ১৯৭৮ সালে কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন বিআরবি (বজলার রহমান অ্যান্ড ব্রাদার্স) ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। আস্তে আস্তে দেশের বাজারে অবস্থান করে নেয় প্রতিষ্ঠানের পণ্য। তারপর দেশের বাইরে নজর দেন তিনি। এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদাকে শীর্ষে তুলে ধরছেন বিআরবি গ্রুপ তাদের উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে। আর দেশের বেকারত্ব মোচন, অর্থনীতির গতি সঞ্চার ও দেশের রপ্তানি খাতকে এগিয়ে নিচ্ছেন সমান তালে। মজিবর রহমান প্রতিষ্ঠানটির চেয়াম্যান। তার মতে, দেশে কোনো কিছু করা না গেলে, বাইরে গিয়েও কিছু করা যায় না। ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেন,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের অর্জন আরও সূদুরপ্রসারী করতে চাই।
প্রতিষ্ঠানের শুরু সম্পর্কে মজিবর রহমান বলেন, নিজেদের মূলধন ও ব্যাংকের অর্থায়নে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮০ সালে। ১৯৯৪ সালে গোটা দেশে বিদ্যুতায়নের প্রসার ঘটলে ক্যাবল উৎপাদন বাড়নো হয়। ১৯৯৬ ও ২০০০ সালে উন্নত বিশ্বের উন্নত যন্ত্রপাতি স্থাপন করে কারখানার সমপ্রসারণ করা হয়। বর্তমানে উন্নত ও গুণগতমান সম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ক্যাবল বাজারের স্থান করে নিয়েছে বিআরবি গ্রুপ। এখন এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্য ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া এ গ্রুপে বর্তমানে ১২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৬ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছে এখানে। এর মধ্যে বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ, কিয়াম মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এমআরএস ইন্ডাস্ট্রিজ, বিআরবি পলিমার, বিআরবি সিকিউরিটিজ, টিপিটি ক্যাবলস, লাভলী হাউজিং, কিয়াম সিরাতুন্নেসা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, বিআরবি এনার্জি, বিআরবি এয়ার, বিআরবি ট্রাভেলস, গ্যাস্ট্র লিভার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট লিমিটেড।
জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি দেশে শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা জনপদ কুষ্টিয়াকে সমৃদ্ধ জেলায় রূপান্তরেরও অন্যতম কারিগর এই বিআরবি গ্রুপ। স্থানীয় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই কুষ্টিয়া অঞ্চলে নতুন করে শিল্পায়নের সূচনা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুষ্টিয়ার খ্যাতনামা শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোহিনী মিল বন্ধ হয়ে যায়। নাজুক হয়ে পড়ে কুষ্টিয়া টেক্সটাইল মিলের অবস্থাও। জেলার বৃহৎ কর্মস্থানের এ ক্ষেত্র দুটি ভঙ্গুর হয়ে পড়লে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এ জেলা।
এমন অবস্থায় নানা রকমের ঝুঁকি সত্ত্বেও নতুন করে শিল্পকারখানা দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু করেন মজিবর রহমান। এ প্রচেষ্টা বাস্তবরূপ লাভ করে ১৯৭৮ সালের ২৩শে অক্টোবর কুষ্টিয়া শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ বিসিক শিল্প নগরীতে বৈদ্যুতিক ওয়্যারস ক্যাবল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। দেশে ও বিশ্ব বাজারের বৈদ্যুতিক ক্যাবলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৫ সালে কোম্পানির প্রসার ঘটিয়ে বিআরবি ক্যাবলস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ইউনিট-২ স্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটি।
মজিবর রহমান বলেন, বিআরবি উৎপাদনের ধারাবাহিকতায় শুধু বৈদ্যুতিক ক্যাবলই তৈরি করছে না তাদের উৎপাদনের সঙ্গে আরও সংযোজিত হয়েছে টেলিকম টিউব লাইন ব্যালস্টসহ ৯৯ হাইভোল্টেজ ক্যাবল, যা এদেশের মধ্যে শুধু বিআরবিই তৈরি করছে। অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বিআরবি ক্যাবল তার সাফল্যের আরও এক ধাপ এগিয়ে আইএসও ৯০০২ : ২০০০ সনদপ্রাপ্ত হয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। শিল্প উৎপাদনে-রপ্তানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তিনি সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন বেশ কয়েক বার।
যেভাবে সম্প্র্রসারণ হয় গ্রুপটির: উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় গ্রাহক চাহিদা মেটানোসহ কর্মসংস্থানের জন্য ২০০৯ সালে নতুন প্লান্ট স্থাপন করে উৎপাদন করছেন বৈদ্যুতিক ফ্যান। যার নাম লাভলী ফ্যান, যা বাজারে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। টেকসই ও মজবুত হওয়ায় লাভলী ফ্যান অল্প সময়ে মানুষ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে এ ফ্যান বাংলাদেশের এক নম্বর ব্র্যান্ড হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে বলে জানান চেয়াম্যান।
২০১১ সালে বিআরবি গ্রুপে যুক্ত হয় আর একটি নতুন অধ্যায়। বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মেরিন ক্যাবল উৎপাদন করে ব্যবসায় নজির স্থাপন করায় কোম্পানি ব্যাপক সুনাম অর্জন করে।
আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক ও আকর্ষণীয় মেটালিক পণ্যসামগ্রী রান্নাঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য মজিবর রহমান ১৯৯০ সালে কিয়াম মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে কুষ্টিয়া বিসিক শিল্প নগরীতে আরও একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
কুষ্টিয়ায় ১৯৯২ সালে বিআরবি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত এমআরএস ইন্ডাস্ট্রিজ নামে আরও একটি প্রকৌশল, ঢালাই, প্লাইউড ও মেলামাইন বোর্ড কারখানা প্রতিষ্ঠিত করেন গ্রুপটি।
কৃষিপ্রধান দেশর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে উন্নত সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিআরবির স্বপ্নদ্রষ্টা আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৯৭ সালে বিসিক শিল্প নগরী কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন বিআরবি পলিমার লিমিটেড।
২০১১ সালে বিসিক শিল্প নগরীর মূল হাইওয়েতে এমআরএস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ফিলিং স্টেশন স্থাপন করেন।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চয়তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিসিক শিল্প নগরীর বিআরবি চত্বরে ২০০৯ সালে স্থাপন করেন বিআরবি এনার্জি লিমিটেড। এই বিদ্যুৎ সরবরাহের ফলে বিআরবি গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে গতিশীলতা ফিরে এসেছে।
অন্যদিকে ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সড়কে ২০০০ সালে ১০তলা বহুতল ভবন বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স ‘লাভলী টাওয়ার’ স্থাপন করেন।
আকাশপথের মাধ্যমে সারা দেশে দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত করতে বিআরবি গ্রুপে যুক্ত হয় বিআরবি এয়ার লিমিটেড। বর্তমানে বেল ৪০৭ জিএক্স নামের একটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিআরবি এয়ারের যাত্রা শুরু হয়।
গ্রুপের কর্ণধার মো. মজিবুর রহমান কুষ্টিয়ায় কিয়াম সিরাতুননেছা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করে দরিদ্র ছাত্রদের বিনামূল্যে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার হজ ও ওমরাহ পালন করেছেন। নিজ খরচে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক মসজিদ, মাদরাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন।
মজিবর রহমান বলেন, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে ও স্বনির্ভর কুষ্টিয়া প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বিআরবি গ্রুপ। দেশের সমৃদ্ধি ও বেকারত্ব মোচনে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, আর এটা সম্ভব হয়েছে কুষ্টিয়াবাসীসহ দেশের সবার সার্বিক সহযোগিতায়। বিআরবির পণ্যের মান উন্নত হওয়ার কারণে বিশ্ব দরবারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্যাবল তৈরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিনে। গোবি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে সারা বিশ্বের তালিকাভুক্ত ৩ হাজার ক্যাবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিআরবি ৩৩তম। মানের কারণে বিআরবি ৩ বার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি অর্জন করেছে।
ড্যাফোডিলে মজিবর রহমান
২০ আগস্ট ডিআইইউ ইন্ডাস্ট্রি অ্যাকাডেমিয়া লেকচার প্রোগ্রামের তৃতীয় পর্বের আয়োজন করা হয়। এদিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপিস্থিত ছিলেন বিআরবি ক্যাবলের চেয়ারম্যান মোঃ মজিবর রহমান। সেখানে তিনি লিখিত বক্তব্যে তার শুরু এবং সফলতার গল্প শোনান। তার পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইনোভেশন এ্যান্ড ইনকিউবেটর সেন্টারের পরিচালকব মো: আবু তাহের। লিখিত বক্তব্য পাঠের পর মোঃ মজিবুর রহমান অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন পেশার মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেন। এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সফলতার সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। তাই সফল হতে পরিশ্রম করার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নীতি-নৈতিকতা, সততা ও মানসিক সুশৃঙ্খলতা শুধুমাত্র উপাসনা কক্ষের বিষয় নয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে, জীবন –জীবিকা এবং আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রেও এসবকে মেনে চলতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে পুস্তক থেকে অর্জিত জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তবে প্রয়োগপযোগী দক্ষতাও অর্জন করতে হবে, যাতে নিয়োগকারী উদ্যোক্তারা বলতে না পারেন যে তারা উপযুক্ত লোক পাচ্ছেন না। এ বাস্তবতাকে বিচেনায় নিয়ে ড্যাফোডিল
ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভার্সিটি কারিক্যুলামে প্রয়োগিক শিক্ষাকে যুক্ত করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শিল্প-কারখানার সাথে যুক্ত করে তাদের হাতে- কলমে কাজ শিখিয়ে প্রকৃতপক্ষেই কর্মক্ষম হয়ে উঠার সুযোগ করে দিচ্ছে। তিনি দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও এ পথ অনুসরনের আহবান জানান।
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে মজিবুর রহমান বলেন, নতুনভাবে কোনো কিছু শুরু করতে হলে সবার আগে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করতে হবে। অনেক বাধা আসবে সেগুলো মোকাবেলা করার মতো সাহসী হতে হবে। ব্যার্থতাকে ভয় পেলে হবে না। ব্যার্থতাকে পেছনে ফেলেই এগিয়ে যেতে হবে।
উক্ত অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভার্সিটির ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ সবুর খান, বিআরবি ক্যাবলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভেজ রহমান, পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফী মিজানুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হামিদুল হক খান ও ইনোভেশন এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের পরিচালক মোঃ আবু তাহের। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (স্টুডেন্ট এফেয়ার্স) সৈয়দ মিজানুর রহমান।
সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ সবুর খান বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ এর চেয়ারম্যান মোঃ মজিবর রহমানের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন।
মজিবর রহমানের বক্তব্যের ভিডিও দেখুন: https://www.youtube.com/watch?v=6VtMwKsMgNo