টাটা সাম্রাজ্যের বাদশাহ : রতন টাটা
- লিডারশিপ ডেস্ক
টাটা ভারতের সর্ববৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ছয়টি মহাদেশের ১০০টি দেশে শতাধিক কোম্পানির মাধ্যমে টাটা গ্রুপের ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। রতন টাটা ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপের সঙ্গে জীবনের অর্ধশত বছর কাটিয়ে ২০১২ সালে অবসরে যান। তখন প্রতিষ্ঠানটির আয় ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রতন টাটার বর্ণাঢ্য ব্যবসায়িক জীবনের নানা গল্প নিয়ে থাকছে আজকের আয়োজন-
জিরো থেকে হিরো রতন টাটার পিতাকে দত্তক নিয়েছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার নিঃসন্তান ছোট ছেলে। দশ বছর বয়সে ছেড়ে গেছেন সে বাবা। দাদির কাছে পালিত রতন টাটা শূন্য হাতে শুরু করেছিলেন পথচলা… রতন টাটা। যার কিছুই ছিল না। অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতোই যার বেড়ে ওঠার গল্প লেখা যেত। কিন্তু পরিশ্রম আর ভাগ্যের অপূর্ব এক কারসাজি গল্পকেও ছাড়িয়ে গেছে। রতন টাটার বাবার নাম নাভাল টাটা। তার পিতাকে দত্তক নিয়েছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার নিঃসন্তান ছোট ছেলে। জামশেদজি টাটার এই গ্রুপে ভাগ্য ফেরে নাভাল টাটার। তবে রতন টাটার শৈশব মোটেই রঙিন ছিল না। নাভাল টাটা দুটি বিয়ে করেছিলেন।

প্রথম সংসার ভেঙে গিয়েছিল ১৯৪০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। নাভাল টাটার প্রথম স্ত্রী সোনির গর্ভেই জন্ম নেন রতন টাটা। তখন রতন টাটার বয়স ছিল দশ। তার আরেকভাই জিমির বয়স ছিল সাত বছর। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে রতন টাটা ও তার মাকে অসহায় এক জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। জীবন থেমে থাকেনি। এই অসহায় শিশু ও তার মাকে ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন দাদি লেডি নাভাজবাই। মুম্বাইয়ের এক স্কুলেই প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করেন রতন টাটা। ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন ক্যানন স্কুল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। এরপর পড়াশোনা করেছেন আর্কিটেকচার, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। হাভার্ডে পড়েছেন অ্যাডভান্স ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে।
টাটা গ্রুপের সঙ্গে তার কর্মসূত্রে পরিচয় ঘটে ১৯৬১ সালে। টাটা স্টিলে কাজ শুরু করেন। শুরুতে ব্লাস্ট ফার্নেস সরানোর মতো কাজ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে জে আর ডি টাটা রতন টাটার মেধা ও পরিশ্রম করার মানসিকতার মূল্য দেন। তিনি রতন টাটাকে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান করেন।
এ নিয়ে ব্যবসায়িক মহলে বহু সমালোচনা শুরু হয়। বলা নেই কওয়া নেই, একজনকে ধরে এনে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে দেওয়া- এ তো স্রেফ সিনেমাতেই ঘটে। সিনেমার ঘটনাই বাস্তবে ঘটল। অন্যদিকে সমালোচকরা মুখর থাকে সব সময়ই। ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালানোর অভিজ্ঞতা যার নেই তাকে দিয়ে কিছুই হবে না। তবে দাবার দান উল্টে গেল। সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল তার হাত ধরেই সাফল্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তরতর করে বাড়ছে প্রতিষ্ঠানের অর্থ। ভারতের একটি সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করেন। এটি হয়ে ওঠে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। সঠিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, আত্মবিশ্বাস ও ঝুঁকি নিয়ে রতন টাটা দেখিয়ে দিলেন মানুষ চাইলে স্বপ্নকেও ছুঁয়ে দেখতে পারে।
জীবনের সবচেয়ে বড় সময় এই টাটা গ্রুপের সঙ্গেই কাটিয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে টাটা গ্রুপ থেকে অবসর নেন তিনি। তবে বিদায়ের চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারই প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীরা। এমনকি ভারতের অন্য বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। গোদরেজ গ্রুপের চেয়ারম্যান আদি গোদরেজ বলেই বসেন, আমরা ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাকে স্যালুট করি, তিনি সাহস ও নৈতিকতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে সারাবিশ্বে জনপ্রিয় করেন। রতন টাটা তার টাটা গ্রুপকে শুধু ভারতে নয়, নিয়ে গেছেন এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে। ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন বহু দিকে। টাটা মোটরসের অনেক যন্ত্র ও টাইটান ঘড়িকে আরও আধুনিক ও সুন্দর ডিজাইন দিয়েছেন রতন টাটা। টাটা গ্রুপে যোগদানের আগে তিনি লস অ্যাঞ্জেলসভিত্তিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান জোনস অ্যান্ড ইমনসে কাজ করতেন। শূন্য হাতে শুরু করে শত বিলিয়ন সম্পত্তি রেখে যাওয়ার এই গল্প রূপকথাকেও হার মানায়।
এক কিংবদন্তি

রতন টাটা এক কিংবদন্তি। শুধু ভারতবর্ষেই নন, তিনি সারা বিশ্বের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের কাছে এক উচ্চারিত নাম। বিভিন্ন কারণে তিনি এই অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন। টাটা গ্রুপের কথা শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বিভিন্ন গাড়ির কথা। ট্রাক থেকে লরি, প্রাইভেট কার। টাটা নামটিকে এই গাড়ি প্রস্তুতকারক নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বলেই চেনে সবাই। ১৯৯৮ সালে বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি টাটা ইন্ডিকো নামে প্রথম প্যাসেঞ্জার কার আনে। অল্প খরচে বেশি মাইলেজ এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেই এই প্যাসেঞ্জারকারগুলো মানুষের আস্থা লাভ করে। যে কারণে দুই বছরের মধ্যে গাড়িটি ভারতে এক নম্বর জায়গা দখল করে। নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ভারতের সবেচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত লাভ করে টাটা। এই প্রতিষ্ঠানের অন্য একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সবার নজর কাড়ে। টাটা গ্রুপ সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্পূর্ণভাবে গাড়িটি তৈরি। আর পুরো প্রক্রিয়া হয় দেশেই। তার সময়েই টাটা মোটরস জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার বাজারে আনে। এটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় সারা বিশ্বে। শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, অভিজাত গাড়ি হিসেবেও সবাইকে ছাড়িয়ে যায় জাগুয়ার। ক্রেতারা গাড়ি বাজারে আসার আগেই দীর্ঘ লাইন দেন গাড়িটির অগ্রিম বুকিং দেওয়ার জন্য। শুধু কি গাড়ি ব্যবসা? বেভারেজ কোম্পানি হিসেবে টাটা টি হয়ে ওঠে সারাবিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়। অনেকেই হয়তো শুনেছেন টেটলি টির নাম। যুক্তরাজ্যের এক নম্বর চা কোম্পানি এটি। এটিও টাটা গ্রুপের বেভারেজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত। এ ছাড়া রয়েছে স্টিল ব্যবসা। দেশের সীমা ছাড়িয়ে টাটা স্টিল ইউরোপীয় লিমিটেড গঠন করে। আর লন্ডনের বাজারটি কব্জা করে নেয়। নিউইয়র্কের পিয়েরে হাটেলও টাটার। ভারতের সবচেয়ে বড় স্টিল কোম্পানিটি বৃহত্তম আউটসোর্সিং ফার্মটিও টাটার। টেলিকম সেক্টরেও টাটা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। টাটা গ্রুপের ৬৫ ভাগ রাজস্ব আসে বিদেশ থেকে। ১৯৬০ সালে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ঘোষণার আগ পর্যন্ত টাটাসহ ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে শেয়ার ছিল। ১৯৯০ সালে সরকার যখন বেসরকারি খাতে ব্যাংক করার অনুমতি দেয় তখন এ সেক্টরে বিনিয়োগ করেনি। জীবনবীমা ও সাধারণ বীমা সুবিধাও দিচ্ছে টাটা ক্যাপিটাল। মধ্যবিত্ত শ্রেণি গাড়ির মালিক হবেন এ স্বপ্ন বাস্তব রূপ দেন তিনি।
১৯৯১ সালে টাটা চেয়ারম্যান হওয়ার কিছুদিন আগে ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করে। রতন টাটা এর পুরো সুবিধা নেন। তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি ৪৩ গুণ বৃদ্ধি পায়। ২০০৮ সালে যখন মুম্বাইয়ে তাজ হোটেলে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে রতন টাটা নিজে উপস্থিত থেকে কর্মী ও হোটেলের অতিথিদের উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করেন। হোটেলটি টাটা গ্রুপেরই ছিল। ১৯৯১ সালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। রতন টাটা এই ব্যবসাতেও টাকা ঢালতে চেয়েছিলেন। ‘‘ রতন টাটা ১৯৯১ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হওয়ার কিছুদিন আগে ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করে। রতন টাটা এর পুরো সুবিধা নেন। তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি ৪৩ গুণ বৃদ্ধি পায়।
১০০ বিলিয়ন ডলার
টাটা গ্রুপের যাত্রা শুরু ১৮৬৮ সালে। রতন টাটা সেই গ্রুপের চেয়ারম্যান হন ১৯৯১ সালে। তারপর থেকে গল্প পাল্টে যায়। এ যেন ম্যাজিক। মোটরগাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে স্টিল, বেভারেজ, সফটওয়্যার… প্রথম সারির বহু ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্ত ভিত গড়ে দেন। টাটা গ্রুপ তার হাত ধরে রূপ নেয় একটি বৃহত্তর করপোরেট বাণিজ্যিক গ্রুপ হিসেবে। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও পরিচিত ব্র্যান্ডের তালিকায় নাম লিখিয়েছে টাটা গ্রুপ। ২০১২ সালে তিনি টাটা গ্রুপ থেকে সরে আসলেও গ্রুপের কর্মকতা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের অনুরোধে এখন তিনি টাটা গ্রুপের চ্যারিটেবল ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। যেতে যেতে ১৪৪ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠানের নামে সম্পদ রেখে গেছেন প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। ভারতের গোটা শেয়ারবাজারের ৭ শতাংশ টাটা শিল্পগোষ্ঠীর দখলে। ভারতের করপোরেট ট্যাক্সের ৩ শতাংশ আসে এই গ্রুপের কল্যাণে। অনুমান করতে কষ্ট হয় না আর্থিক দিক থেকে টাটা গ্রুপকে কতটা শক্তিশালী অবস্থানে তুলে নিয়েছেন তিনি।
লবণ, সফটওয়্যার, লোহা আর গাড়ি সব ব্যবসাতেই সফল 
১৮৬০ সালে জামশেদ টাটা প্রতিষ্ঠা করলেও সেটির বর্তমান ভিত আরও মজবুত হয় রতন টাটার হাত ধরে। ১৯৯১ সালে দায়িত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন রতন টাটা। সাফল্যের গল্পগুলোর সমষ্টি জানান দিয়েছে, টাটা গ্রুপ একটি বৈশ্বিক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত করেছেন রতন টাটা। টাটা গ্রুপের নানাদিকে ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত দুটি ভাগে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে। একটি হলো টাটা সন্স, অন্যটি টাটা ইন্ডাস্ট্রিজ। টাটা গ্রুপ মোট আট ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করে । এগুলো হলো- তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ, প্রকৌশলী পণ্য ও সেবা, পণ্যদ্রব্য, জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, কেমিক্যাল এবং আন্তর্জাতিক কার্যক্রম। এ সাতটি ব্যবসায়িক খাতে টাটা গ্রুপের ১০০টি কোম্পানি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির মোট কর্মচারীর সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি। রতন টাটা নেতৃত্বে মোট ব্যবসার সংখ্যা শতাধিক। লবণ ব্যবসা থেকে শুরু করে সফটওয়্যার পর্যন্ত সব ব্যবসায়ই সুনাম ধরে রেখেছেন তিনি। এ ছাড়া ব্যবসা রয়েছে আবাসন খাত থেকে শুরু করে এয়ারকন্ডিশনিং, হোটেল শিল্প, গাড়ি শিল্প, ফোন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বীমা, ঘড়ি, পাদুকা পর্যন্ত। তবে টাটা গ্রুপের ব্যবসায়িক মাইলফলক বলা যায় ২০০৬ সালে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারে ইস্পাত বহুজাতিক কোরাসকে অধিগ্রহণ। ইস্পাত ব্যবসায় আধিপত্য ছড়াতে এটি একটি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত ছিল। এ ছাড়া ২০০৮ সালে ২৩০ কোটি ডলারে ব্রিটিশ গাড়ি প্রস্তুতকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভারের মালিকানা অর্জন করে টাটা। রতন টাটা জাগুয়ারকে নিজের করে নিয়ে বিশ্বে গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাড়ের ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেন। এটি রতন টাটার অনন্য কীর্তি। এ ছাড়া টাটা গ্রুপের টিসিএসকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা হিসেবে। বিদেশে ভারতীয় হোটেল ব্যবসার সম্প্রসারণে রয়েছে টাটার উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা। বেভারেজ ব্যবসায় টেটলির কথা বলা যায়। টাটা টির ব্যবসাও ঢেলে সাজানো হয়েছে। এ ছাড়া অলাভজনক টেক্সটাইল ও বেশ কিছু নন-কোর ব্যবসা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এর মধ্যে এসিসি ও টমকো উল্লেখযোগ্য ছিল। রতন টাটা কেন্দ্রীয় ব্র্যান্ডিং পর্যায়ে আনতে একটি নিয়মতান্ত্রিক নেটওয়ার্কের সাহায্যে এর সব কোম্পানিকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন।
অন্যরকম রতন টাটা
৫০ ইউরো জরিমানা
একবার খাবার অপচয়ের দায়ে জরিমানা দিতে হয়েছিল রতন টাটাকে। ভারতীয় ধনকুবের অবশ্য কোনো কথা না বাড়িয়েই সেটা দিয়েছিলেন। জার্মানি গিয়ে এক রেস্তোরাঁয় খাবার নষ্টের অপরাধে তাকে ৫০ ইউরো জরিমানা করা হয়। এই সামান্য অর্থ জরিমানা হয়তো রতন টাটার জন্য বড় কোনো বিষয় নয়, তবে সেই দিন রেস্তোরাঁয় গিয়ে যা শিখেছেন তিনি তা সত্যিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। ওই দিনের বর্ণনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে দেওয়া এক পোস্টে তুলে ধরেন রতন টাটা। তিনি লিখেন, বিশ্বের অন্যতম শিল্পোন্নত দেশ জার্মানি। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন যে ওই দেশের নাগরিকরা খুবই বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। সহকর্মীকে নিয়ে হামবুর্গে একটি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন তিনি। যেহেতু তারা খুব ক্ষুধার্ত ছিলেন সে জন্য বেশ অনেকটা খাবার অর্ডার করেছিলেন রতন টাটার সহকর্মী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খাবারই ছুঁয়েও দেখা হলো না তাদের। এরপর রতন টাটা এবং তার সহকর্মী যখন রেস্তোরাঁ থেকে বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল ওই সময়ে এক বয়স্ক নারী বিরক্ত হয়ে তাদের বললেন, তোমাদের খাবার নষ্ট করা উচিত হয়নি। সহকর্মী ওই নারীকে উত্তর দিলেন, ‘আমরা টাকা দিয়ে খাবার কিনেছি।
খাবার নষ্ট করব, নাকি খাব এটাতে তোমার মাথা ঘামানোর কী আছে? এ উত্তরে বেশি খেপে গেলেন ওই নারী। সঙ্গে থাকা আরেকজন তৎক্ষণাৎ ফোন বের করে কাকে যেনো ফোন দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থার পোশাক পরা এক ব্যক্তি এসে হাজির হলেন। ওই ব্যক্তি সব কিছু শুনে রতন টাটা এবং তার সহকর্মীকে ৫০ ইউরো জরিমানা করে বসলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যান রতন টাটা। তারপর সেই কর্মকর্তা রাগান্বিত সুরে বললেন, ‘তুমি তোমার টাকায় খাবার কিনলেও, সম্পদ তো সমাজের। বিশ্বের অনেক মানুষ সম্পদের অভাবে রয়েছে। সুতরাং সম্পদ নষ্ট করার কোনো অধিকার তোমার নেই।

‘বাংলার বাঘিনী’র দেওয়া শিক্ষা
২০০৬ সালের ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সিংগুরে টাটা গোষ্ঠী ন্যানো গাড়ি কারখানা নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে যায়। এতে আপত্তি তুলে জমি দিতে অনিচ্ছুক কৃষকরা। তাদের নিয়ে আন্দোলনে নামেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আন্দোলনে টিকতে না পেরে পিছুটান দেয় রতন টাটা। টাটা গ্রুপ ২০০৮ সালে ন্যানো গাড়ির কারখানা গুজরাটে নিয়ে যায়। তারও দুই বছর পর রতন টাটা কলকাতায় এসে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের ভবিষ্যৎ নেই। সে নিয়ে কম জল ঘোল হয়নি। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যারা জানেন, কথার নড়চড় হয় না তার। এরও বহু বছর পর চেন্নাইয়ে এক অনুষ্ঠানে রতন টাটা সেই ক্ষত মনে করে বলেন, তাকে ‘বাংলার বাঘিনী’ শিক্ষা দিয়েছেন। আরও বলেন, সরকারের মুখ্য পদে ‘আক্রমণাত্মক’ কেউ অধিষ্ঠিত থাকলে সেক্ষেত্রে বিবেচনা করে এগোনোই ভালো। কেননা, সিংগুর তাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে।
ন্যানোতেই ব্যর্থ
সবার জীবনেই ব্যর্থতা আছে। রতন টাটাও ব্যতিক্রম নন। তার দীর্ঘ ব্যবসায়িক জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার তিলক টাটা মোটরস-এর ন্যানো গাড়ি প্রকল্প। ২০০৮ সালে বাজারে রতন টাটা আনেন পৃথিবীর সবচেয়ে কম দামের প্রাইভেট কার। টাটা ন্যানো। তখন এর দাম ছিল মাত্র এক লাখ রুপি। যা ভারতে একটি মোটরসাইকেল থেকেও কম দাম। দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়- ন্যানোকে সবচেয়ে সস্তার গাড়ি বলে। কিন্তু বাজারে আসার পর স্তম্ভিত হয়ে যান রতন টাটা। ন্যানো প্রকল্প পুরো মাঠে মারা যায়। বিক্রির নামগন্ধ নেই। এ ছাড়া মানুষের কাছে ন্যানো গাড়িও দৃষ্টিকটু বলে সমালোচিত হয়। শেষ পর্যন্ত রতন টাটাও মেনে নেন, ন্যানোকে সস্তা গাড়ি বলে প্রচার করা ভুল হয়েছিল। তিনি জানান, ন্যানোকে সবচেয়ে সস্তার গাড়ি হিসেবে তুলে না ধরে সবচেয়ে ‘অ্যাফোর্ডেবল’ বা সাশ্রয়কর গাড়ি হিসেবে প্রচার করা উচিত ছিল। রতন টাটার মতে, কোনো মানুষই নিজেকে ‘সস্তার গাড়ির’ সঙ্গে যুক্ত করতে চান না।
টাটা গ্রুপের ভবিষ্যৎ কী? এই প্রশ্ন অনেকেরই মাথাতেই ঘুরছে। বিশেষ করে রতন টাটা সরে যাওয়ার পর টাটা গ্রুপের কী হবে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা কম হয়নি। ১৮৬৮ সালে মাত্র ২১ হাজার রুপি পুঁজি নিয়ে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন ব্যবসায়ী ও জনসেবক জামশেদ নওশেরাওজি টাটা। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। একপর্যায়ে হাল ধরেছেন রতন টাটা। তিনি বিশ্বের অন্যতম শিল্পোদ্যোক্তা। বিশ্বের অন্যতম সফল এই ব্যবসায়ীর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে টাটা গ্রুপের নামটি। টাটা গ্রুপ ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বরাবরই উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রেখেছে। রতন টাটার নামটি সে সূত্রেই সামনে চলে আসে। বিশ্ব দরবারে ভারতকে অন্য উচ্চতায় তুলে ধরতে রতন টাটার ভ‚মিকা আলাদা করে না বললেই নয়। টাটা গ্রুপের বহুমুখী ব্যবসার কারণে সারা বিশ্বেই এ গ্রুপের ওপর মানুষের আস্থা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ব্র্যান্ডিংয়ে রতন টাটার কৌশল পুরোপুরি কাজে লেগেছে। যে কারণে ভারতীয় পণ্যকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছেন রতন টাটা। ১৯৯১ সালে রতন টাটা চেয়ারম্যান হিসেবে হাল ধরেছিলেন টাটা গ্রুপের। তারপর নানা উত্থান-পতনের সঙ্গী হয়েছেন। অনেক সাফল্যের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন।
রতন টাটা ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপের সঙ্গে জীবনের অর্ধশত বছর ২০১২ সালে অবসরে যান। তিনি যখন অবসর নেন, তখন প্রতিষ্ঠানটির আয় ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ৭৭ বছর বয়সী এ শিল্পপতি জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় কাটিয়েছেন এই গ্রুপের সঙ্গে। অবসরের পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে থাকবেন সম্মানসূচক ইমেরিটাস চেয়ারম্যান হিসেবে। রতন টাটার উত্তরাধিকারী হিসেবে সাইরাস মিস্ত্রির নাম ঘোষণা করা হয়। সাইরাস মিস্ত্রি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর রতন টাটা বলেছিলেন, সাইরাসের যোগ্যতা ও ধীশক্তিতে তিনি মুগ্ধ।
‘মিস্ট্রি অ্যান্ডস, মিস্ত্রি বিগিনস’ শিরোনামে ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’ যে সংবাদটি প্রচার করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ‘টাটা সান্সের বাছাই কমিটি যখন নির্মাণ ব্যবসায়ী, নিভৃতচারী ও স্বল্প পরিচিত সাইরাস মিস্ত্রিকে নির্বাচিত করল, তখন তা খুব বিস্ময়কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। ভারতসহ বিশ্বের বেশির ভাগ সংবাদপত্র, সাময়িকী বা টিভি চ্যানেল সাইরাসের নিয়োাগকে ‘অপ্রত্যাশিত’ ও ‘অনাকাক্সিক্ষত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মূলত সাইরাসের স্বল্প পরিচিতিই এর কারণ।