যার কেউ নেই তার পাশেই সাইফুল
- লিডারশিপ ডেস্ক
তরুণ সাইফুল ইসলাম চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাকি সময় কাটান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অজ্ঞাতনামা, অসহায় রোগীদের সেবা করে। যার কেউ নেই, তার পাশেই তিনি দাঁড়ান। তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েই সাইফুলের শান্তি। দশ বছরে প্রায় ২০০ মানুষ বাড়ি ফিরে গেছেন সাইফুলের সহায়তায়।
ভ্লাদিমার কুলতুভের যখন জ্ঞান ফিরছে, তখন তিনি দেখতে পাচ্ছেন আবছা একটি টানেল, তার অপর প্রান্তে দেখা যাচ্ছে হালকা আলো, তিনি দৌড়াচ্ছেন সে আলোর দিকে আর নরম আলোর আবির মেখে দুহাত বাড়িয়ে তাঁর দিকে ছুটে আসছেন যমজ ভাই আদিলভ। তাঁর আবছা হাসি-হাসি মুখে বিন্দু বিন্দু ফুটে উঠছে মমতা। ভাইয়ের মমতামাখা মুখ দেখতে দেখতে তিনি আবার জ্ঞান হারালেন।
আবার যখন তিনি চেতনে ফিরে এলেন, তখন ঘোরের মধ্যে তাঁর মনে হলো, আমি কোথায়? আমার মাথার পাশে উদ্বিগ্ন অসম্ভব মায়ামাখা চেহারাটি কার?
কুলতুভ আসলে তখন ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ইউক্রেনের এই নাগরিক বাংলাদেশে এসেছিলেন একটি বিমান পরিবহন কোম্পানির কার্গো বিমানের ক্রু হিসেবে। কক্সবাজার থেকে চিংড়ির পোনা নিয়ে তাঁরা উড়ে যেতেন দেশের নানা প্রান্তে। গত বছরের ৯ মার্চ তাঁদের সোনালি ডানার ছোট্ট বিমান বঙ্গোপসাগরে আছড়ে পড়ে। পাইলটসহ বাকি তিনজন ক্রু সঙ্গে সঙ্গে নিহত হন। কেবল বেঁচে যান তিনি। আর হাসপাতালে অর্ধচেতন অবস্থায় তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটির নাম সাইফুল ইসলাম। সবাই তাঁকে চেনে নেসার নামে। পেশায় ডিপ্লোমা প্রকৌশলী নেসার কিন্তু হাসপাতালের কোনো কর্মী নন, কুলতুভকেও তিনি এর আগে দেখেননি। তাহলে মরণাপন্ন ভিনদেশি এ বিমানকর্মীর পাশে তিনি কেন?
এখানেই নেসারের আলাদা পরিচয়, যা একটি কথাই আবার প্রমাণ করে, মানুষের মহত্ত্বের চেয়ে বড় কিছু নেই। ২৫ বছরের এ যুবক চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, আর চাকরির পর বাকি সময় কাটান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অজ্ঞাতনামা, অসহায় রোগীদের সেবা করে। যার কেউ নেই, তার পাশেই তিনি দাঁড়ান, সুস্থ করে তোলেন। তারপর তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েই তাঁর শান্তি। এ অসাধারণ মানবিক কাজের মাধ্যমে তিনি প্রায় ২০০ মানুষের সেবা করেছেন, যাঁদের অনেকেই সুস্থ হয়ে তাঁর হাত ধরে বাড়ি ফিরে গেছেন। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন।
তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন এ কাজে জড়ালেন?’
একধরনের বেদনা ফুটে উঠল তাঁর চেহারায়, বললেন, পড়তাম ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে, তার পাশেই ফেনী হাসপাতাল। প্রায়ই সেখানে যেতাম, দেখতাম, কত অসহায় রোগী কষ্ট পাচ্ছেন, তখন নিজের অজান্তে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো শুরু করলাম। প্রথম প্রথম রক্ত জোগাড় করে দিতাম, পরে নিয়মিত সেবায় লেগে গেলাম। ব্যাপারটি মাথায় আরও বেশি ঢুকে যায় ২০০৭ সালে টাকার অভাবে বাবা যখন প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। তখন প্রতিজ্ঞা করলাম, যত সামান্য আয়ই করি না কেন, তা খরচ করব অসহায় রোগীদের জন্য। সেই থেকে শুরু। বিশেষ করে অজ্ঞাতনামা রোগীদের জন্য কিছু করতে মন চায়, কারণ, তাদের দেখার, খরচ দেওয়ার কেউ নেই।
এ সেবাকে নেসার একধরনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন, তাই রোগীর খবর পেলেই তিনি দ্রুত হাসপাতালে ছুটে আসেন, ওষুধ কিনে দেন, পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দেন। তাঁর ভাষায়, যখন সেই রোগী ভালো হয়ে স্বজনদের খোঁজ পান, বাড়ি ফিরে যান, তখন আনন্দে কেঁদে ফেলি। আবার অনেকের সুস্থ হওয়া হয় না, চিরনিদ্রার কোলে ঢলে পড়েন, তখন মন ভেঙে যায়, মনে হয়, আহা! কার যেন সোনামানিক, জানতেও পারল না কোথায় শুয়ে আছে!
এ পর্যন্ত কতজন রোগীকে সেবা দিয়েছেন, জানতে চাইলে নেসার অতৃপ্তি নিয়ে জবাব দেন, মাত্র ২০০। অবাক বিস্ময়ে দীর্ঘ মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকি, একদম অপরিচিত ২০০ মানুষকে বিনা স্বার্থে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সেবা করে বলছেন, মাত্র ২০০! তাঁর ওয়েবসাইটে (www.mdnasar.org) অনেকের তথ্যই রয়েছে।
এই যে অজ্ঞাতনামা রোগীদের পেছনে এত টাকা খরচ করেন, পারিবারিকভাবে সমস্যা হয় না, জিজ্ঞেস করতেই নেসার তৃপ্তির হাসি হাসেন, না, হয় না, বরং তাঁরা উৎসাহ দেন, এমনকি আমার মা তাঁদের জন্য খাবার রান্না করে দেন। তাঁদের এবং নিজের অনেক শখ-আহ্লাদ মেটাতে পারি না, তা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই, বরং তাঁরা আমার কাজ নিয়ে গর্বিত।
কথা হয় নেসারের সাহায্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া রোগী স্মরণজিত বড়ুয়ার ভাই বরণজিত বড়ুয়ার সঙ্গে। এ ভদ্রলোক চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। ভর্তি করা হয় অজ্ঞাতনামা রোগী হিসেবে। খোঁজ পড়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বন্ধু নেসারের। তিনি পরম আত্মীয়ের মতো স্মরণজিতের পাশে থেকে, নিজের পয়সায় ওষুধ কিনে তাঁকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে দেন। এ রোগীর ভাই বরণজিত বললেন, ‘আমরা কখনোই নেসার ভাইয়ের ঋণ শোধ করতে পারব না। আমরা সবাই যখন নিখোঁজ ভাইয়ের জন্য পাগলপ্রায়, তখন তিনি নিজের দায়িত্বে তাঁর চিকিৎসা করিয়েছেন, বাড়ি ফিরিয়ে এনেছেন। তিনি না থাকলে হয়তো ভাই বাঁচতেন না, বলতে বলতে টেলিফোনের অপর পারে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন বরণজিত।
একই কথা বললেন নাঙ্গলকোটের পারভীন। তাঁর বোন রুমাও দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তারপর তাঁর সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নেসার, ভাইয়ের মমতায়। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি রুমাকে বাঁচাতে পারেননি, তবে তাঁর লাশ পরম মমতায় স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
নেসারের ব্যাপারে কথা হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. নারায়ণ ধরের সঙ্গে। তিনি বললেন, এ যুবক অসহায়, দরিদ্র, অজ্ঞাতনামা রোগীদের জন্য যা করেন, তার কোনো তুলনা হয় না। এ নিঃস্বার্থ সেবায় তাঁর নিবেদন দেখে খালি এটুকুই বোঝা যায়, বুকের গভীরে মায়ার অতল সাগর না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
২৫ বছরের টগবগে এ যুবক যৌবনের সমস্ত আনন্দ বিসর্জন দিয়ে হাসপাতালের নীরস পরিবেশে রোগীদের পাশে কেন সময় কাটান, তা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি মুচকি হেসে বলেন, নিজেও জানি না, তবে প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই হাসপাতাল আমাকে ডাকে। মনে হয়, সেখানে অপেক্ষা করছেন কোনো এক অসহায় মানুষ, যার পাশে কেউ নেই, আমাকে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, এক্ষুনি দাঁড়াতে হবে। সে অদৃশ্য ডাকে আমি ছুটে যাই, আর কোনো বিনোদন আমাকে ডাকে না।
একেই কি বলে মানবতার ডাক? নিজেকেই জিজ্ঞেস করি, আবার নিজেই উত্তর দিই, হ্যাঁ, কেবল অপার্থিব মানবতার ডাক শুনতে পেলেই এটা সম্ভব। আর এ ডাক সবাই শুনতে পারেন না, কেবল ‘অন্য রকম’ মানুষেরাই পারেন।
সাইফুল ইসলাম সেই অন্য রকম মানুষ, তাই তিনি ডাক শুনতে পান হাসপাতালে শুয়ে থাকা অসহায় মানুষের, সন্ধ্যা নামলেই সেখানে ছুটে যান গভীর রাতে। পুরো শহর যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তিনি মমতা নিয়ে জেগে থাকেন অপরিচিত রোগীর শয্যাপাশে।