আব্দুস সাত্তারের ‘স্ফুলিঙ্গ’
- লিডারশিপ ডেস্ক
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তানি বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে দুই দলে ভাগ হয়ে পালাতে থাকে। শহরের মানুষ বিজয় পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। যদিও শহর ছাড়িয়ে মুড়লী, রাজারহাট, রূপদিয়ায় তখনো যুদ্ধ চলছিল। আব্দুস সাত্তার তখন ৩২ বছরের যুবক। স্ফুলিঙ্গ নামের একটি পত্রিকা শত্রুমুক্ত যশোরে ছড়িয়ে দিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই। দিনটি ছিল ৯ ডিসেম্বর। শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র এটি।
সে দিনের গল্প
আব্দুস সাত্তার এখন পরিষ্কার করে কথাও বলতে পারেন না। তবু বলে গেলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আমি কবি নাসিরউদ্দিনের ‘গণদাবি’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলাম। ৬ ডিসেম্বর যশোর শত্রুমুক্ত হলে আমি একটি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিই। কিন্তু সব প্রেস বন্ধ। একপর্যায়ে আমি শহরের জামে মসজিদ লেনের ইমপিরিয়াল প্রেসের মালিক রফিক সাহেবকে খুঁজে পাই। তাঁকে আমি শক্ত করে ধরি। তাঁর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে দুজন প্রেস শ্রমিককে তাঁদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসি। ৮ ডিসেম্বর রাত জেগে কাজ করি। কাঠের ব্লকে স্ফুলিঙ্গ লেখা হয়। শীষের টাইপ দিয়ে সংবাদ কম্পোজ করা হয়। অবশেষে ৯ ডিসেম্বর সকালে স্ফুলিঙ্গ ছাপা হয়ে প্রকাশিত হয়। ওই দিনের স্ফুলিঙ্গের একটি লেখায় আমি যশোরকে শত্রুমুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাই। চার পাতার ক্রাউন সাইজের পত্রিকার দাম রাখা হয় চার আনা। ৫০০ কপি স্ফুলিঙ্গ পত্রিকা ছাপা হয়েছিল সেদিন।’
বিজয় সমাবেশ ১১ ডিসেম্বর
যশোর টাউন হল মাঠে কলকাতা থেকে বিজয় সমাবেশ করতে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আকাশবাণীর সাংবাদিক উপেন চক্রবর্তী, লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের পিটার গিলসহ দেশ-বিদেশের আরো অনেক সাংবাদিক। সাত্তার সেই সমাবেশের খবর সংগ্রহ করেন। ১২ ডিসেম্বর আবার ছাপা হয় স্ফুলিঙ্গ। সাত্তার প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি প্রচার করেছিলেন, ‘বাংলার মাটিতে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।’ মুক্তিকামী মানুষের হাতে হাতে ছিল স্ফুলিঙ্গ।’
সাত্তারের সঙ্গে যশোর শহরের চুড়িপট্টি এলাকার বাসিন্দা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা আলমগীর সিদ্দিকীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৯৭০ সালের দিকে মওলানা ভাসানী যশোরে এসে আলমগীর সিদ্দিকীর বাড়িতে সভা বসিয়েছিলেন। সাত্তার সেই সভায় ছিলেন। সাত্তারকে ডেকে ভাসানী বলেছিলেন, ‘তুই নিজেই একটি পত্রিকা বের কর। নাম দিবি স্ফুলিঙ্গ। তোর স্ফুলিঙ্গ নিপীড়িত মানুষের পক্ষ নিয়ে জালেমদের জ্বালাইয়া-পুড়াইয়া দিবে।’ সাত্তার নামটি মনে রেখেছিলেন। স্ফুলিঙ্গ প্রথম নিবন্ধিত হয় ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক হিসেবে। মিয়া আব্দুস সাত্তার প্রধান সম্পাদক। প্রকাশক সাত্তার সাহেবের স্ত্রী রাশিদা সাত্তার। ১৯৭৪ সালে পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে আবার যখন প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে স্ফুলিঙ্গ, তখন সেটি দৈনিক হিসেবে নিবন্ধিত হয়। যশোরের প্রথম দৈনিক। ‘বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনা’ (বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত) শীর্ষক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রের প্রকাশনাক্রমে স্ফুলিঙ্গের অবস্থান সপ্তম। বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক সংবাদ দ্বিতীয়, এরপর আজাদ, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ও সংগ্রাম। আর সংগ্রামের পরেই আছে দৈনিক স্ফুলিঙ্গ। এটি দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম দৈনিক।
স্ফুলিঙ্গ অনিয়মিত পড়ে
১৯৯৫ সালে পত্রিকার প্রকাশক রাশিদা সাত্তার মারা যান। ২০০৩ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন প্রধান সম্পাদক মিয়া আব্দুস সাত্তার। এরপর পত্রিকার প্রকাশনা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ২০০৫ সালে জেলা প্রশাসন এই পত্রিকার ডিকলারেশন বাতিল করে দেয়।
একজন মিয়া আব্দুস সাত্তার
ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার সোনাতুন্দি গ্রামে মিয়া আব্দুস সাত্তার ১৯৩৯ সালের ১৫ মে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আদিলুদ্দীন ছিলেন মসজিদের ইমাম। মা মাজেদন্নেছা সাধারণ গৃহিণী। আব্দুস সাত্তার সোনাতুন্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তারপর গোপালগঞ্জের ট্যাংরাখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ম্যাট্রিক পাস করেন নগরকান্দা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। আইএ পাস করেন প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে। ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জাগরণ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। আব্দুস সাত্তার, ‘আমাদের গ্রামের আব্দুল হাই নামের এক ব্যক্তি জাগরণ পত্রিকায় কাজ করতেন। তিনি আমাকে পত্রিকার সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের কাছে নিয়ে যান। সম্পাদক আমার সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হয়ে নিয়োগ দিয়ে দেন। জাগরণে আমি চার বছর কাজ করেছি।’ এরপর তিনি দৈনিক সংবাদের ফরিদপুর সংবাদদাতা হন। সাত্তারের শ্যালক থাকতেন যশোরে। ১৯৭০ সালে তিনি যশোর বেড়াতে আসেন। কয়েক দিন থাকার পর যশোর তাঁর ভালো লেগে যায়। একপর্যায়ে তিনি কবি নাসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক গণদাবি পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। তারপর প্রকাশ করেন স্ফুলিঙ্গ। নাম লেখান ইতিহাসের পাতায়।