করপোরেট জগতে বিজয়িনী ইসমাত
- লিডারশিপ ডেস্ক
অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে আমার জীবন। একটা বিষয় আমি ঠিক রেখেছি যে, কোনো দিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়িনি। মনে মনে বলেছি- আমার দক্ষতা থাকে, মানসিক শক্তি থাকে, লক্ষ্যে অটুট থাকি, আমি এগিয়ে যাবো। আমার সংকল্প ছিল নিজের পায়ে দাঁড়াব।’ এটি ছিল করপোরেট জগতের এক সর্বজয়া ইসমাত জাহানের জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারার মূলমন্ত্র। তিনি বর্তমানে আসীন হয়ে আছেন দেশের প্রসিদ্ধ আইটি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক আইটি সার্ভিসেস লিমিটেডের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রধান হিসেবে।
নিজের জীবনের বাধাগুলো টপকে এত দূর আসার পর ইসমাত জাহান এখন চেষ্টা করছেন অন্যদের চলার পথকে সুগম করে তোলার। বর্তমান অবস্থান থেকে পেছনে ফিরে দেখতে চাইলে কেমন দেখেন এ সর্বজয়া নিজের পথচলাকে? আর কী-ই বা তিনি জানাতে চান ভবিষ্যত্ যোদ্ধাদের? এমন প্রসঙ্গে ইসমাত জাহানের জবাবগুলো ছিল খুবই স্পষ্ট।
কর্মক্ষেত্রে এ নারীর যাত্রা শুরু একদমই শিকড় থেকে। পছন্দের ক্যারিয়ার হিউম্যান রিসোর্স বিভাগে, এর ওপর বিবিএ, এমবিএ করে শিক্ষার নানা ধাপ পার করেই সামনে এগোনো। লক্ষ্যে পৌঁছতে কাঠখড় তো পোড়াতে হয় সবাইকেই, কিন্তু ইসমাত জাহান মনে করেন, জটিলতাগুলো মেয়েদের জন্য একটা জায়গায় গিয়ে অনেক বেশি মনে হতে থাকে। এ দেশে এখন পর্যন্ত মেয়েদের নিজেদের প্রমাণ করতে যেন পুরুষদের চেয়ে একটু বেশি কষ্ট করতে হয়।
আজ পর্যন্ত সমস্যাগুলো অনেক জায়গাতেই রয়েছে। সামাজিক বাধা তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে একজন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রধান হিসেবে নারী কর্মীদের মধ্যকার যে সমস্যা তিনি দেখেছেন প্রকটভাবে তা হলো, তাদের নিজেদের মধ্যে দানা বাঁধা এক প্রকার ‘ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ কিংবা ‘আমি বোধ হয় পারব না’— এমন ধারণা। অথচ এ রকম ধারণা আরোপ করা হয় গতানুগতিক পারিবারিক ও সামাজিক চিন্তাধারা থেকেই।
একটি ছেলে আর একটি মেয়ে দুজনই সমান প্রতিভাবান, কেউ কারো চেয়ে কম নয়। তারা ভালো শিখে এসেছে, একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই ফল করে আসছে। ছেলেটা একটা সময় এগিয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানে ঢোকার দুই থেকে তিন বছর পরে একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে। কেন? তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সে একটা ভিন্ন জীবনে অনুপ্রবেশ করছে। কিন্তু কেন এমন হবে? তারা দুজনই তো সমান প্রতিভাবান। অর্থাত্, সেক্ষেত্রে মেয়েটির উচিত হবে এ অবস্থার উত্তরণে আরেকটু বেশি চেষ্টা করা। আর সেজন্য ভালো একটা ‘মেন্টরিং’-এর ব্যবস্থা করা উচিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই, বলছিলেন ইসমাত জাহান।
ভবিষ্যতে সব কর্মীর জন্য ভালো কর্মপরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রেও একটি প্রতিষ্ঠানের এসব সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত বলে পরামর্শ দেন তিনি। এক্ষেত্রে কর্মীর কাজকে সময় দিয়ে বিচার না করে ‘কার্যকারিতা’র ধারণা দিয়ে বিচার করলেই এ সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব বলে মনে করেন এ ব্যবস্থাপক।
সঙ্গে রয়েছে কর্মক্ষেত্রের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তার অভাব। নারীর জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ একটা সমাজ ব্যবস্থা এ দেশে এখনো তৈরি হয়ে ওঠেনি। আবার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেও লিঙ্গবৈষম্য বা হয়রানির শিকার হলে অনেক নারীই সেটি বলতে ইতস্তত বোধ করেন। এটি থেকেও নারীদের বেরিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন ইসমাত জাহান। আর এসব সমস্যায় নিজের প্রতিষ্ঠানে যেমনটি চর্চা করেন, তেমন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গ্রহণ করতে আহ্বান জানান তিনি।
এর পরও ইতিবাচক ধারণা রাখেন ইসমাত জাহান। কারণ যেমনটি তিনি বলেন, পরিবর্তন রাতারাতি ঘটে যাওয়ারও ব্যাপার নয়। আজ থেকে ১০ বছর আগে পরিস্থিতি যেমনটা ছিল, তার থেকে বেশ উন্নত হয়েছে লোকের দৃষ্টিভঙ্গি। নিজ প্রতিষ্ঠানে নারীদের অংশগ্রহণে গঠিত ফোরাম ‘উত্তরণ’ এবং ‘জেসিআই ঢাকা অ্যাচিভার্স’ নামক আরেকটি সমাজসেবামূলক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেও কাজ করে যাচ্ছেন পরিবর্তনের লক্ষ্যে।
আরো বলেন, সাফল্যে যেমন সহযোগিতা করবে পরিবার ও প্রতিষ্ঠান, তেমনই প্রত্যয়ী হতে হবে নিজেকেও। ‘যখনই কেউ বলবে যে তুমি এগিয়ে যেও না, তখনই তাকে ছেড়ে সামনে আগাতে হবে। তুমি জানো যে, তোমার উদ্দেশ্য কী? মনোযোগ, সংকল্প ও মানসিক দৃঢ়তা— এ তিনটি জিনিস থাকলে কখনো পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়।’ ভবিষ্যত্ যোদ্ধাদের উদ্দেশে এটাই এ তেজস্বী নারীর স্পষ্ট উচ্চারণ।