মনের আলোয় আঁধার জয়
- লিডারশিপ ডেস্ক
আমরা প্রায়শই দেখতে পাই চোখের আলো নিভে গেলেও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে সমাজকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা। কিন্তু অনেক সময় উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের যে সংগ্রাম তা দৃষ্টিগোচর হয় না। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে একটি বড় অংশই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। অধিকাংশ প্রতিবন্ধীই প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পায়। এরপর তাদের শিক্ষার আলো হারিয়ে যেতে বসে।
যতটুকু মনে আছে প্রথম শ্রেণিতে পড়াকালে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে বইয়ের পাতায় দেখেছিলেন ইঁদুর-বিড়ালের ছবি। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আঁধারে ঢেকে যায় সাইদুলের জগৎ। কিন্তু জীবনে হার মানেননি সাইদুল হক। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে সম্পন্ন করেছেন স্নাতকোত্তর। চোখের আলো নেই তবুও শিক্ষক হয়ে সমাজে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর।
সাইদুল হকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে বরিশালে সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তির পর থেকেই শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। সেই সময় ব্রেইল পদ্ধতির বই পুস্তকের অভাব ছিল। ছিল মানুষের অবজ্ঞা অবহেলা। এই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সেখান থেকে ১৯৮৩ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৮৫ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। একজন দৃষ্টিহীন মানুষেরও যে উচ্চ শিক্ষা অর্জন সম্ভব, তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাইদুল হক।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালে এক হতাশা সাইদুলকে প্রতিনিয়তই তাড়া করত। যেন সব কিছু থেকেই বঞ্চিত প্রতিবন্ধীরা। পাচ্ছে না বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা। দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোও সম্ভব ছিল না সে সময়ে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল সাইদুলসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধীর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দৃষ্টিহীন ছাত্র পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। সংগঠনটির মাধ্যমে শুরু হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিভিন্ন কার্যক্রম। এখানেই সাইদুল থেমে যাননি। ছাত্রজীবন থেকে চেয়েছিলেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে যেন মানুষের বোঝা না হতে হয়, অবজ্ঞা আর অবহেলা নিয়ে না বাঁচতে হয়। সিদ্ধান্ত নেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন যেখানে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ করে যায়। তাই ১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই গড়ে তোলেন ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন (বার্ডো) নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শুরু থেকেই বার্ডো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ অন্য প্রতিবন্ধীদের সমাজে মূল ধারায় প্রতিষ্ঠা করার কাজ করে আসছে । সমাজে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সৃজনশীল সমাধান তৈরির জন্য ১৯৯৪ সালে সাইদুল অশোকা ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়, ব্রেইল লাইব্রেরি, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, সচেতনতামূলক কর্মশালা ও মেডিকেল কার্যক্রম চালিয়ে আসছে বার্ডো। সরকারি কিংবা বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগের পাশাপাশি কর্মস্থলে একজন প্রতিবন্ধীর কর্মসহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া দেশের তিনটি জেলায় রয়েছে বার্ডোর সমাজভিত্তিক পুনর্বাসনের মতো কার্যক্রম। ভারতীয় হাইকমিশন, জাপান এম্ব্যাসিসহ ও ঢাকা জেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তা আর সাইদুলের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা নিজ প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে রয়েছে ২৮ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্র। এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বার্ডোর নিজস্ব বিদ্যালয়ে পড়ে থাকে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য তাদের বাইরের মূলধারার স্কুল ও কলেজে পাঠানো হয়। বাইরের স্কুল-কলেজগুলোতে প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষার উপযুক্ত উপকরণ অধিকাংশই থাকে না। এসব শিক্ষার্থীকে ব্রেইল পদ্ধতির বই, রেকর্ড করা বই ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করে থাকে বার্ডো। মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করার সরকারি নির্দেশ থাকলেও সেখানে পড়ালেখা করতে গিয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। তাই প্রতিবন্ধীদের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়ে আসার জন্য বার্ডো বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সাইদুল মনে করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও এসব শিক্ষার্থী বেশ মেধাবী। কিন্তু মানুষের সচেতনতার অভাবেই তারা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। স্বল্প পরিসরে হলেও বার্ডো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধীর সুযোগ করে দিচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আসা সহায়তায় চলে পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। সমাজে বিভিন্ন বিত্তশালী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এ সাহায্য সহায়তা করে থাকেন। অন্য সবার মতো স্কুলে যাওয়া, কম্পিউটার চালানো যাদের স্বপ্ন ছিল, সাইদুলের কল্যাণে তাদের আশা আজ পূরণ হয়েছে। তাদের অন্ধকার জীবনে মনের অলো ধরে রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সাইদুলের কথায় বার বার উঠে আসছিল, প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, সুযোগ পেলে তারাও দেশের সম্পদ হয়ে উঠবে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে পড়ালেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতায় পড়তে হয় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের। এদের শুধু বিশেষ স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এসব শিশুর শিক্ষা এবং সেবার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করে বার্ডো। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে আসছে।
পৃথিবীর যে সৌন্দর্য, তা কি দেখতে ইচ্ছা করে না_ জানতে চাইলে সাইদুল বলেন, ইচ্ছা করলেও তা সম্ভব নয় জানি। তাই মনের চোখ দিয়ে চেষ্টা করি দেখার। পুরুষের তুলনায় নারী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা অনেকটা পেছনে, তাই সাইদুলের স্বপ্ন নারী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য একটি আলাদা স্কুল প্রতিষ্ঠা করার। তার বিশ্বাস প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ পুরোপুরি কার্যকর হলে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী কেউ পিছিয়ে থাকবে না।