অপরাজিতা রিজওয়ানা
- লিডারশিপ ডেস্ক
শৈশবের স্বপ্নাতুর চোখ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকে। অথবা এমনটা বলা যেতে পারেন এই সমাজ ব্যবস্থাই শিশুর চোখে সেই স্বপ্ন বুনে দেয়। যার ফলে এই পেশাগুলোই ঘুরেফিরে আসে। তবে আইনজীবী রিজওয়ানার গল্পটা ভিন্ন। আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন তাকে কখনো গ্রাস করেনি। বাবা আইনজীবী হওয়ার কারণে এ পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল ছোটবেলা থেকেই।
ঢাকায় ধানমন্ডিতে রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা। পড়েছেন শহরের নামকরা স্কুলে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি ইংরেজি মাধ্যমে। তবে মাধ্যমিক শেষ করেছেন অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। স্কুলের গল্প বলতে গিয়েই বলছিলেন, ‘আমাদের সময় আর এখনকার সময়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেশ ফারাক আছে। সে সময় আমাদের কোন চাহিদা ছিল না। বাবা-মা যা দিতেন, সেটাতেই সন্তুষ্ট থাকতাম। কখনো মুখ ফুটে কিছু বলিনি। এখন তো ছেলেমেয়েরা নিজেদের ইচ্ছার কথা বলতে পারে।
ছোটবেলায় খুব ভালো ছাত্রী ছিলেন না বলেই দাবি করেন রিজওয়ানা। বরং ভালো লাগত রঙ তুলিতে ক্যানভাস রাঙাতে। প্রাথমিকের পর থেকেই ছবি আঁকার তালিম নিয়েছেন। নবম শ্রেণীতে ওঠার আগে থেকে ভালো ফলের সুবাদে ভালো ছাত্রীর তকমা লাগতে শুরু করে। আর তাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার আগ্রহ তৈরি হয় তখন। যদিও গণিত খটমটে মনে হয়েছে সবসময়। কিন্তু বাবা রাজি না হওয়ায় মানবিক বিভাগেই পড়তে হয়।
মজার ব্যাপার ঘটে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর। কেননা যে গণিতকে ভয় পেতেন আর সেটিতেই পেয়েছেন রেকর্ড মার্ক। সে বছর স্টার মার্ক নিয়ে পাস করে তাক লাগিয়েছিলেন। হলিক্রস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পার হন। এর পরই তো স্বপ্নপূরণের সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগে ১২৮তম স্থান দখল করেন তিনি। হাজার হাজার শিক্ষার্থী টপকে এমন অবস্থান নিঃসন্দেহে বড় সাফল্যই। স্নাতক করার বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন আইনকে। বিপত্তি বাধল তখনই, কেননা আইনজীবী বাবা বেঁকে বসেছেন মেয়েকে আইন নিয়ে পড়াবেন না বলে। তার মতে, নারীর জন্য এটা পেশা নয়। বরং তার ইচ্ছা মেয়ে আইনজীবী নন বরং স্কুল শিক্ষিকা কিংবা এমন কোনো পেশায় নিযুক্ত হোক। কিন্তু তত দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিজওয়ানা ক্লাসও শুরু করেছেন।
এক মাসের মতো ক্লাস করার পর বাবার পছন্দে বিয়ে দেয়া হয় তাকে। বরাবরের বাধ্য মেয়েটি এবারও মুখ ফুটে বলেননি আসলে তিনি কি চান। বিয়ের পর চট্টগ্রাম চলে যেতে হয় শ্বশুরবাড়িতে। এতে আইন নিয়ে পড়াশোনার ইস্তফা দিতে হয় সেখানেই। তবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা থেকে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ইংরেজিতে স্নাতক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ততদিনে রিজওয়ানা দুই সন্তানের মা। কিন্তু স্নাতকোত্তরের ফলাফল প্রকাশের আগেই দুই সন্তানসহ ঢাকায় চলে আসেন। তখন মূলত যুদ্ধ করেই জীবনযাপন করেছেন সন্তানদের নিয়ে।
সে সময় ধানমন্ডি টিউটোরিয়াল স্কুলে পড়াতেন। রিজওয়ানার ভাষায়, প্রচণ্ড খারাপ সময় গিয়েছে সেটা। আর সে সময়ই ব্রেন টিউমারে বাবা মারা যান। অন্যদিকে স্বামীর সঙ্গেও বিচ্ছেদ ঘটেছে তত দিনে। বাবা আইনজীবী হওয়ায় তার মৃত্যুর পর তার লাইব্রেরি, তার চেম্বার কেনার জন্য মানুষ কিছুটা বিরক্তই করতে লাগল রিজওয়ানার পরিবারকে। কিন্তু তারা বিক্রি করতে রাজি ছিলেন না। আর তখনই তার পরিবারের সবাই তাকে আইন নিয়ে আবার পড়ার ব্যাপারে বলতে থাকেন। তখন মায়ের সহযোগিতায় ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব টিসাইড-এ আইন নিয়ে পড়তে যান।
তবে সন্তানদের ছাড়া সেখানে থাকা কষ্টকর হওয়ার কারণেই দেশে ফিরে আসেন এলএলবি শেষ হওয়ার আগেই। এবং তখন এক বছরের ক্রেডিট ট্রান্সফার করেন ইউনিভার্সিটি অব উলভারহ্যাম্পটনে। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশেই পরীক্ষা দিয়ে এলএলবি সম্পন্ন করেন। এর পরই বার কাউন্সিল ভোকেশনাল কোর্সে আবেদন করেন ইউনিভার্সিটি অব নর্থ অ্যাম্ব্রিয়ায় এবং বেশ ভালোভাবে সম্পন্ন করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পান।
তবে আইনজীবী হওয়ার ধাপ সম্পন্ন হলেও থেমে যাননি রিজওয়ানা। আইন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি এই বিষয়ে বিভিন্ন ট্রেনিংও শেষ করেছেন দেশে-বিদেশে। অন্যদিকে একটা স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের সক্রিয় সদস্য তিনি, যেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করেন। ছুটির দিনগুলোয় রিজওয়ানাকে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানেই। সন্তানরা বাইরে পড়াশোনা করছে বিধায় তাদের সঙ্গ বেশ মিস করেন এগিয়ে যাওয়া এই নারী। সমাজের সব শ্রেণীর নারীর প্রতি তার পরামর্শ, বয়সের অজুহাতে যাতে কেউ থেমে না থাকেন এবং কাজে লাগাতে হবে ইচ্ছাশক্তিকে।